এক স্বপ্নের উড়ান: এ পি জে আব্দুল কালাম রচনা

এক স্বপ্নের উড়ান: এ পি জে আব্দুল কালাম রচনা
এক স্বপ্নের উড়ান: এ পি জে আব্দুল কালাম রচনা

ভূমিকা

তামিলনাড়ুর সাধারণ পরিবার থেকে ভারতীয় জাতীয় জীবনের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন ‘মিসাইল ম্যান’ শিক্ষক ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম। তাঁর জীবনটাই যেন স্বপ্নের উড়ান-যে স্বপ্ন দেশময় ছড়িয়ে দিয়ে ২৭শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ শিলং-এ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের এক মঞ্চে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে ‘ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’-এ তিনি দেশবাসীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। সেইসঙ্গে তাঁর স্বপ্নের উড়ান থেমে গেল। যে স্বপ্ন তিনি দেশবাসীকে দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নদ্রষ্টার এই হঠাৎ চলে যাওয়া দেশবাসীর কাছে বড়ই বেদনার।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ

আবদুল পাকির জয়নালউদ্দিন আব্দুল কালাম সংক্ষেপে এ পি জে আব্দুল কালাম তামিলনাড়ুর তিট্টাকুন্তির সন্তান। বাবার সঙ্গে প্রথম জীবনে তিনি যেতেন দরিয়ায় মাছ ধরতে। ধনুষ্কোটি রামেশ্বরমের ঘাটে নৌকা নিয়ে বাবার সঙ্গে দূর সমুদ্রে যেতেন। কালাম তখন তাকিয়ে থাকতেন আকাশের দিকে যেখানে সমুদ্র ও আকাশ মিশে গিয়েছে। যেখানে ছোট ছোট বিন্দুর মতো ভেসে থাকা পাখির দল স্বচ্ছন্দে উড়ত। আর একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট কালাম স্বপ্ন দেখত, সেও একদিন ঐ পাখিদের মতো উড়ে বেড়াবে আকাশে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অদ্ভুত প্রকৃতির। কেননা কুয়োর জলে, ঢিল ফেলে আপন মনে তিনি হাসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, জলে ঢেউ দেখতে তাঁর ভাল লাগে। অথচ দারিদ্র্যের মধ্যেও এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনা মিলিয়ে যায়নি বলেই তিনি একজন ‘মিসাইল ম্যান’ রূপে খ্যাতি পেয়েছেন।

পটভূমি ও সম্ভাবনা

গরিব জেলে পরিবারের সন্তান হলেও, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হলেও তাঁর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি চিরকালই বহন করে নিয়ে চলেছেন। কেননা খবর কাগজ বিক্রয় করে যিনি তিরুচির সেন্ট যোসেফ কলেজ থেকে পাশ করেছেন তিনিই আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান। সাধ থাকলেও সাধ্য যে নেই, তা তিনি বোঝেন না। এই অবস্থায় কালামের বোন এসে উপস্থিত হয় মুশকিল আসানের মতো। তাঁর বোন নিজের গয়না বিক্রয় করে প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচটি তুলে দেন কালামের হাতে।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

রাষ্ট্রপতি পদে যিনি বৃত হয়েছেন সেই কালাম আগাগোড়াই ভাল মানুষ। কপালে স্কুলে পড়া চুল, সরল হাসি, সাধারণ জামা কাপড়, অতি সাধারণ জীবনযাত্রা তাঁর, বলা যেতে পারে ভারতীয় আদর্শের ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিংকিং’-এর ধাঁচে গড়া মানুষ। মুসলিম হলেও গীতাবিলাসী, নিরামিষাশী এবং কৌমার্যব্রতধারী। গরিব বাড়ির সন্তান হলেও তিনি যথেষ্ট মেধাবী, বিনয়ী, ভদ্র, এমনকি ‘ভারতরত্ন’ উপাধিও পেয়েছেন, একাধারে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও মারণাস্ত্রের জন্মদাতা। নিজে নভশ্চর হননি কিন্তু তাঁর অগ্নি, পৃথ্বী, ত্রিশূল গত কয়েক বছরে একের পর এক উড়ে গেছে আকাশে। ভয়ঙ্করভাবে আছড়ে পড়েছে প্রতিবেশী শত্রুর যাবতীয় আত্মবিশ্বাসের গোড়ায়, আর সেই অগ্নিবাণ উড়িয়েই সেদিনের স্বপ্ন দেখা বালক হয়ে উঠেছিলেন ‘মিসাইল ম্যান’। হয়ে উঠেছিলেন গোটা একটা রাষ্ট্রের নির্ভরতার প্রতীক, অথচ, পঁয়তাল্লিশ বছর বিরাট সরকারি পদে চাকরির পরেও একটা ফ্ল্যাট কেনেননি। আন্না ইউনিভার্সিটির এক কামরার ঘরটাই তাঁর আস্তানা। দিনে আঠারো ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। অবসর কাটিয়েছেন ভারতীদাসান আর সুব্রহ্মণ্য ভারতীয়ারের কবিত। পড়ে। মাতৃভাষা তামিলে কবিতাও লিখেছেন। রুদ্রবীণায় ‘শ্রী’রাগের ঝংকার তুলে মাঝে মাঝে তিনি হারিয়ে যেতেন নিজের মধ্যে। আবার তিনি এত বড় মাপের মানুষ হয়েও একেবারেই আত্মাভিমানী নন বরং তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী।

স্বপ্ন

প্রথিতযশা প্রযুক্তিবিদ, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র, ঋষিসুলভ জীবনযাত্রার অধিকারী, কবি আব্দুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়ে তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘ছোট লক্ষ্য স্থির করাটাই অপরাধ’। তিনি আরও বলেছিলেন ‘একটি দেশ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল, রোগমুক্ত থাকা, সম্পদ উৎপাদনশীলতা, সম্প্রীতিময় জীবন ও মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। ভারতবর্ষের সার্বিক উন্নয়ন এবং শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়াই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্য ছিল। ২০০২-২০০৭ তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে বৃত ছিলেন ও তাঁর পদের যথার্থতা তিনি রক্ষা করেছেন সযত্নে। কেননা তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন-‘মুক্ত ভারত, উন্নত ভারত এবং শক্তিশালী ভারত’-এর।

উপসংহার

তিনি মনে করতেন, ‘বিদায়ের সময়টা ছোট্ট হওয়া উচিত, খুব ছোট।’ হলোও তাই। একজন আদ্যোপান্ত শিক্ষক শিক্ষাঙ্গণে বক্তৃতা দিতে দিতেই বিদায় নিলেন। ভারতের পরমাণু গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ কালামের মৃত্যুতে দেশ হারাল এক বিজ্ঞানীকে। ১৯৯৭ সালের ভারতরত্ন প্রাপক রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী, লেখক, মিসাইল ম্যান ভারতবাসীর কাছে রেখে গেলেন তাঁর স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে-যে স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দেশবাসীকে এবং তাহলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো সার্থক হবে।

Leave a Comment