কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও পরিবেশে তার প্রতিক্রিয়া রচনা

কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও পরিবেশে তার প্রতিক্রিয়া রচনা
কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও পরিবেশে তার প্রতিক্রিয়া রচনা

ভূমিকা

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিপন্ন পরিবেশ, বর্তমান পৃথিবীর তিনটি সমস্যা। আবার Population, Poverty & Pollution-অর্থাৎ জনসংখ্যা, দারিদ্র্য এবং অবনমন-এগুলি একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে কৃষিকে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে উন্নত করতে গিয়ে যে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে কৃষি লাভজনক হলেও কিম্বা তা দারিদ্র্য দূ রীকরণে সাহায্য করলেও তা কিন্তু পরিবেশ ও জনসমষ্টির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা ও সুরক্ষা একান্ত জরুরি।

সবুজ বিপ্লব

পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার দিকে তাকিয়ে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন বিজ্ঞানী নরমান বোরলগ। পৃথিবীব্যাপী খাদ্য উৎপাদনের স্বপ্ন তাঁকে উৎসাহিত করে। তাই তিনি চারা গাছের রোগ, উন্নত বীজ তৈরির বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করেন। সেই উদ্ভাবন দেশে দেশে সবুজ বিপ্লব তথা শস্য উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি সূচিত করে। এই সবুজ বিপ্লবের ফলে ভারতের বহু অঞ্চলে কৃষির উৎপাদনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি কৃষিজীবী সমাজের উন্নয়নও গতিশীল হয়েছে।

উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে বিভিন্নভাবে। যেমন, লাঙলের পরিবর্তে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, ধান ঝাড়ানো মেসিন প্রভৃতির ব্যবহার। আকাশের বৃষ্টির উপর ভরসা করে বসে না থেকে ডিপ টিউবওয়েলের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ জলের সাহায্যে অসেচ অঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা হয়েছে। উচ্চফলনশীল চাষের জন্য বীজেরও ব্যবস্থা হয়েছে। অল্প সময়ে ফসল পাওয়ার জন্য উন্নত বীজও আমদানি করা হয়েছে। কৃষিকে রোগমুক্ত করতে কীটনাশক ব্যবহারও বেড়েছে, বেড়েছে বেশি ফসল লাভের জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহার। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার করে সুষম চাষের ব্যবস্থাও ফলপ্রসূ হয়েছে।

প্রত্যক্ষ প্রভাব

কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানুষকে তার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে-এই উন্নয়নকে গ্রহণ করার ফলে। কেননা যে কোন উন্নয়নের ফলে পরিবেশের যে পরিবর্তন হচ্ছে তার ফলে তিনটি স্তরে তার প্রভাব পড়ছে। যেমন প্রথম স্তরে প্রভাবিত হচ্ছে স্বাস্থ্য, দ্বিতীয় স্তরে প্রভাবিত হয় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং তৃতীয় স্তরে প্রভাবিত হয় বাস্তুতন্ত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে সমাজে ও পরিবেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

(এক) যন্ত্রের ব্যবহার মানেই দূষণ অবশ্যম্ভাবী। তাই ডিজেল, কেরোসিন প্রভৃতি ব্যবহারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। (দুই) ভূগর্ভস্থ জলের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ধান, গম প্রভৃতি চাষ করার জন্য ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার নিঃশেষ হচ্ছে। আর্সেনিক দূষণ এবং নানান জটিল রোগের কারণও এই ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহার। (তিন) কৃষিতে উন্নত বীজ ব্যবহারের ফলে সেই বীজের ফসল কতটা কোন জায়গার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা না যাচাই করে সেইসব বীজের চাষ করে তার উৎপাদিত ফসলের দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এখন তো সংকর প্রজাতির নানা ফসল বহু মানুষের জৈবিক ক্রিয়াকে বিপথে চালিত করছে, ও জিনের পরিবর্তন সাধন করছে। (চার) কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষিত করছে। মাটির জৈব গুণাগুণ বিনষ্ট করছে। (পাঁচ) কৃষিতে কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার শুধু বর্তমানে নয় আগামী দিনেও ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে। কীটনাশক, ছত্রাক নাশক, আগাছা নাশক হিসেবে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৫০০০ প্রকার ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন ও অরগ্যানোফসফরাস যৌগ এই দুই কীটনাশকের মধ্যে ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন সহজে বিনষ্ট হয় না। অর্থাৎ এরা পরিবেশে অবিকৃত অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে পারে ও খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যে জমতে থাকে। এ ধরনের কীটনাশকের প্রভাব সুদূর প্রসারী। খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে এই ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করার ফলে টিউমার, ক্যানসার, চর্মরোগ, হৃদরোগ ইত্যাদি বিবিধ ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কৃষিকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরাই কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগ করে। কীটনাশক স্প্রে করার সময় শ্বাসের সঙ্গে তা দেহে প্রবেশ করে। কীটনাশক বিষক্রিয়া ও অপুষ্টির সংমিশ্রণ জটিলতা বৃদ্ধি করে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কীটনাশকের বিষক্রিয়ার শিকার হয় এবং অনেকের মৃত্যু ঘটে। আবার আগাছা নাশকের ফলে কেঁচোর মৃত্যু ঘটায় মাটির উর্বরতা শক্তিও নষ্ট হয়।

পরোক্ষ প্রভাব

কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পরোক্ষ প্রভাব যথেষ্ট। যেমন: 

(এক) উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কৃষিতে যুক্ত মানুষেরা বেকার হচ্ছে, দেখা দিচ্ছে ছদ্ম বেকারত্ব। এই বেকাররা নানা অসামাজিক ক্রিয়ায় নিজেদে জড়িয়ে ফেলছে।

(দুই) লাঙলের ব্যবহার কৃষিতে বন্ধ হওয়ায় গরু পালন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর ফলে কৃষিতে জৈবসার হিসেবে গোবরের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ জীবনে গরু পালন যে একটা পেশা ও জীবিকা ছিল তা বিলুপ্ত হতে চলেছে।

(তিন) কৃষিতে যুক্ত মানুষেরা যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা কায়িক শ্রম থেকে বিচ্যুত হয়ে অলস ও যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। এই যান্ত্রিকতা অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।

(চার) উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের খরচ উত্তরোত্তর এতই বাড়ছে যে সাধারণ মানুষের পক্ষে এত খরচ করে কৃষিকাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যারা বাধ্য হয়ে খরচ বেশি করছে তারা উৎপাদিত সামগ্রী থেকে সেই খরচ তুলতে না পেরে কেউ কেউ হতাশায় আত্মঘাতীও হচ্ছে। এর ফলে কৃষিজাত সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে।

(পাঁচ) কৃষিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে। মাঠে কীটনাশকের ব্যবহারে জল ও মাছের ক্ষতি হচ্ছে।

উপসংহার

পরিবর্তনের পথেই সভ্যতার বিকাশ হয়। কিন্তু সেই বিকাশ যদি প্রগতি না হয়ে পরাগতি হয়, সেই উন্নয়ন যদি অবনমনের কারণ হয় তাহলে সেই প্রগতি ও উন্নয়ন সম্পর্কে একটি প্রশ্নচিহ্ন এসেই যায়। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের উন্নয়নের দিশা দেখালেও তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পরিবেশ ও মানব সমাজে যে সর্বব্যাপক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। এজন্য চাই সচেতনতা, সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছা। সদিচ্ছা ও সচেতনতাই পারে যে কোনো অবনমনকে প্রতিহত করতে। এ বিষয়ে প্রত্যাশা করা ছাড়া উপায় কী?

Leave a Comment