![]() |
গাছ আমাদের বন্ধু রচনা |
ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বর্তমানে আমরা সভ্যতার যে প্রবণতা দেখি তাতে বোঝা যায়, সে ক্রমশই প্রকৃতির সহজ নিয়ম পেরিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। মানুষের শক্তি জয়ী হচ্ছে প্রকৃতির শক্তির উপরে, তাতে লুটের মাল যা জমে উঠল তা প্রভূত। এই জয়ের ব্যাপারে প্রথম গৌরব পেল মানুষের বুদ্ধিবীর্য, কিন্তু তার পিছন পিছন এল দুর্বাসনা।…. প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তারপরে ফিরে আসে বিনাশের পালা।’ সেই বিনাশের পালা শুরু হয়ে গেছে। কারণ যে গাছ ছিল জন্মলগ্ন থেকে মানুষের বন্ধু, সেই আদি ও অকৃত্রিম বন্ধুকে মানুষ আজ নির্বিচারে নিধন করে চলেছে। কিন্তু আমাদের উচিত বন্ধুকে যথাযথ ব্যবহার করা, তাকে বাঁচিয়ে রাখা, তা না হলে আমরা বিপন্ন হয়ে পড়ব।
বন্ধু কে
বন্ধু কে? বন্ধুর কাজ কী? সংস্কৃত শ্লোকে রয়েছে, “উৎসবে ব্যসনে চৈব, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে/রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।” অর্থাৎ উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, কারাগারে, শ্মশানে যে সাহায্য করে সে প্রকৃত বন্ধু। অবশ্য এখন বন্ধুত্ব বলতে তা বোঝায় না। পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু হয়, না থাকলে বন্ধুত্ব থাকে না। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সুবিধা পাওয়ার জন্য। তাই বন্ধু আসলে বসন্তের কোকিলের মতো, যে শীত বর্ষায় কেউ নয়। অর্থাৎ বন্ধু আসে সুখের দিনে, দুঃখের দিনে নয়। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু সুখের দিনে যেমন উপস্থিত হয় তেমনি দুঃখের দিনেও ছেড়ে যায় না।
বন্ধুত্বের কারণ
এই নিরিখে গাছ আমাদের প্রকৃত বন্ধু-প্রথম বন্ধু ও চিরকালের বন্ধু। কারণ: (এক) সৃষ্টির আদি লগ্নে গাছ ছিল আমাদের বেড়ে ওঠার ও জীবন ধারণের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। (দুই) গাছ আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে-অক্সিজেন যোগান দেয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। (তিন) গাছ যে শুধু আমাদের খাদ্য ও অক্সিজেন যোগান দিয়ে বন্ধুর কাজ করে তা নয়; তারা খরা, বন্যা ও ভূমিক্ষয় রোধ করে, আবহাওয়ার সমতা রক্ষা করে এবং সর্বতোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে বন্ধুর কাজ করে। (চার) গাছ প্রকৃতির জলচক্র, কার্বন চক্র, অক্সিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র প্রভৃতি স্বাভাবিক চক্রগুলিকে সচল ও সক্রিয় রেখে বন্ধুর কাজ করে থাকে। (পাঁচ) গাছ অরণ্য ভূমি সৃষ্টি করে বলে সেই বনভূমিতে বন্যপ্রাণী বাস করে এবং মাটির উপর ঝরা পাতা-লতা ও মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ ছড়িয়ে থাকায় মাটির জল ধারণের ক্ষমতা বাড়ে। তার ফলে বৃষ্টির সমস্ত জল আর নদীগুলিতে নেমে আসে না, বর্ষায় বন্যা হবার আশঙ্কা দূর হয়। তখন গাছ হয়ে ওঠে বন্ধু। (ছয়) মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গাছ বা তার অংশ উপাদান রূপে কাজ করে চলেছে। গাছের কাঠে আমাদের বহুমূল্য আসবাব তৈরি হয়। গাছের পাতা মানুষের রোগ সারায়, তাতে বহুমূল্য ঔষধ প্রস্তুত হয়। (সাত) গাছের নান্দনিক দিকও আমাদের মনকে প্রফুল্ল করে-আমাদের নান্দনিক বোধে উদ্দীপ্ত করে বন্ধুর কাজ করে। (আট) গাছ আমাদের প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে সহায়তা করে। গাছ আমাদের শেখায় ন্যূনতম প্রয়োজন সেরে অপরের জন্য নিজেকে ত্যাগ করতে, সহনশীল হতে, শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ না করতে। এই গুণাবলী কী প্রকৃত বন্ধুর গুণাবলী নয়?
প্রতিকূলতা
যে গাছ আমাদের বন্ধু, তাকে আমরা আমাদের প্রয়োজনে ধ্বংস করছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের বাসস্থান নির্মাণের জন্য, আসবাব নির্মাণের জন্য যথেচ্ছভাবে গাছ আমরা কেটেছি। গাছ কাটার ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে বন্যপ্রাণী এবং বন ও বন্যেরা এখন বিপন্ন। তাই সেই বিপন্নতা আমাদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তুলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন, খরা, বন্যা, ধস, নদীবাঁধে ভাঙন এবং নানা ধরনের দূষণ সৃষ্টি করেছে গাছ কাটার ফলে।
উপসংহার
এই বিপর্যয় ও বিপন্নতাকে উত্তীর্ণ হতে হলে চাই গাছ-এর ব্যবহারকে যথাযথ ও পরিবেশ-বান্ধব রূপে গড়ে তোলা। এজন্য চাই সচেতনতা ও দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ। সচেতনতাই পারে যে কোনো সমস্যার প্রতিকার করতে। যারা গাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বা যারা গাছ কেটে তা বেচে জীবিকানির্বাহ করে তাদের বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে। শুধু আইন প্রণয়ন করে বা সরকারি পদক্ষেপ দিয়ে এই গাছ কাটা বন্ধ করা যাবে না। এর জন্য চাই প্রচার ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। তা করতে পারলে গাছ তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবে, সেই বন্ধুত্ব আমাদের জীবনধারণকে সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে পারবে। তাহলে আমরা রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে পারব-