চারণকবি কবিতার প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও নামকরণ

চারণকবি কবিতার প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও নামকরণ

চারণকবি কবিতার প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও নামকরণ
চারণকবি কবিতার প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও নামকরণ

চারণকবি কবিতার প্রেক্ষাপট

ভারভারা রাও-এর অন্যান্য কবিতার মতো ‘চারণকবি’- ও একটি প্রতিবাদী কবিতা। ১৯৮৫-র ২৩ অক্টোবর কবিতাটি লেখা হয় এক কবির মৃত্যুর প্রতিবাদে। কবিতাটি দক্ষিণ অফ্রিকার কবি ও রাজনৈতিক কর্মী বেঞ্জামিন মোলায়েজের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়।

বেঞ্জামিন মোলায়েজ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার আলেকজান্দ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। নিরাপত্তা পুলিশকে হত্যার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ অক্টোবর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তাঁকে প্রিটোরিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধা বেঞ্জামিন দীর্ঘদিন ধরে বর্ণবিদ্বেষী বোথা সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করতেই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সারা পৃথিবী প্রতিবাদে উত্তাল হলেও মৃত্যুদণ্ড রোধ করে না সরকার। বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকে দৃঢ় ও উত্তাল করে তোলে কবির মৃত্যু।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন মোলায়েজকে যখন ফাঁসি দেয় বোথা সরকার তখন ভারভারা রাও-ও জেলবন্দি। বন্দিশালা থেকে লেখা ছয় সংখ্যক চিঠিতে ভারভারা রাও জানালেন- 

“নিয়মকানুন যখন সব লোপাট
আর সময়ের ঢেউ-তোলা কালো মেঘের দল
ফাঁস লাগাচ্ছে গলায়” 
মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার আগের দিন বেঞ্জামিন দেখা করেছিলেন মায়ের সঙ্গে। শেষ বিদায়ের দিনে এই ত্রিশবর্ষীয় প্রতিবাদী কবি মায়ের কাছে বার্তা দিয়ে যান মুক্তিকামী বিপ্লবীদের জন্য। বলে যান- 
“… আমি যা আছি তার জন্য আমি গর্বিত 
নিপীড়নের ঝড় আমার রক্তের বৃষ্টি দ্বারা অনুসরণ করা হবে, 
আমি আমার জীবন দিতে পেরে গর্বিত 
আমার একক জীবন।”
-এই মর্মান্তিক ঘটনা উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘কবি’ (বাংলা অনুবাদ ‘চারণকবি’) রচনা করতে, আর-এক প্রতিবাদী কবি ভারভারা রাও-কে।

চারণকবি কবিতার বিষয়বস্তু

সার্বিক ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আধুনিক রাষ্ট্র কিংবা সমাজভাবনায় যে নিয়মনীতিগুলি রচিত হয়েছে-কবি ভারভারা রাও ‘চারণকবি’ কবিতায় দেখিয়েছেন, সেসব আইনকানুন সব লুপ্ত হয়ে গেছে, হঠাৎ যেন উবে গেছে সেসব। পীড়িত, শোষিত মানুষের স্বপ্নেরা এ সময়ে পদদলিত, রক্তাক্ত। সর্বহারা মানুষগুলির উঠোনে একের পর এক দুঃসময়ের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। লন্ডভন্ড করে দিয়েছে জীবনটাকে। বল প্রয়োগ করে রাষ্ট্র ওদের গলায় ফাঁস লাগিয়ে দিয়েছে। ওদের জীবনীশক্তি আজ নিঃশেষিত। এখন আর ওরা রক্তাক্ত হয় না, চোখে জল আসে না। জীবনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। ঘন অন্ধকার আকাশ থেকে মুহুর্মুহু বাজ পড়ে। ঝরে-পড়া বৃষ্টি প্রশমিত করতে পারে না ওদের নিঃসীম জীবনযন্ত্রণাকে। তবু তারই মাঝে কোনো কবি কারাগারে বন্দি অবস্থাতেও বাইরের মুক্তিকামী মানুষের জন্য অমর লিপিমালা, শাশ্বতস্বর উচ্চারণ করে চলেন।

রাষ্ট্রশক্তির চোখরাঙানিকে তুচ্ছ করে যে কবি দিনবদলের সুর বেঁধেছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁর গলাতেই ফাঁস পরাল। কবির বুদ্ধসংগীতই হয়ে উঠল সাধারণের অধিকার অর্জনের হাতিয়ার। জনতার প্রতিরোধের সামনে ফাঁসির মঞ্চ নেমে আসে মাটির কাছাকাছি। আর ফাঁসুড়ে রাষ্ট্রতন্ত্রের গলাতেই আটকে যায় বহুপ্রতীক্ষিত সেই ফাঁস।

চারণকবি কবিতার নামকরণ

ভূমিকা: 

শিল্পসাহিত্যে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেলুগু ভাষার প্রতিবাদী কবি ভারভারা রাও-এর ‘চারণকবি’ (ভাষান্তর : কবি শঙ্খ ঘোষ) পাঠ্যরচনার নামকরণটি বিষয়ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ। মূল রচনার নাম ছিল ‘কবি’। ইংরেজি ভাষান্তরে নাম হয় ‘The Bard’। বাংলা নামটিও তারই অনুসারী।

চারণকবি কারা: 

চারণকবিরা ভ্রাম্যমাণ গায়ক-কবি, মধ্যযুগে তাঁরা বীরগাথা গেয়ে বেড়াতেন। তাঁদের গান যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করত। পাঠ্যকবিতাটি কবি ভারাভারা রাও রচনা করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবাদী কবি ও মুক্তিযোদ্ধা বেঞ্জামিন মোলায়েজের স্মরণে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী বোথা সরকার তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ফাঁসির আগের দিন মৃত্যুর প্রহরগোনা সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে যান মোলায়েজের মা। মোলায়েজ তাঁকে অন্তিমবার্তা দেন এক কবিতায়। মোলায়েজের অন্তিমবার্তা সারাবিশ্বের মুক্তমনা মানুষদের প্রতিবাদী করে তোলে। কাব্যরচনার পটভূমি বিচারে তাই ‘চারণকবি’ নামটি সার্থক।

পাঠ্য কবিতায় কাব্যবর্ণনাও উচ্চারণ করেছে- 

“মায়ের বেদনাশ্রু বুকে নিয়ে 
জেলের গরাদ থেকে বেরিয়ে আসছে 
কবির কোনো লিপিকার স্বর।”

অন্তর্নিহিত অর্থ: 

কবির প্রতিবাদ কাব্য হয়ে উঠলে ক্ষমতালোভী শাসক ভয় পায়। কবিকে বন্দি করে। ফায়ারিং স্কোয়াড, ফাঁসিকাঠের আয়োজন করে। কিন্তু কবিপ্রাণ মৃত্যুভয়হীন; চিরসুন্দর। হননের আয়োজনের মাঝে কবি লিখে চলেন আগুনের অক্ষর। সে অক্ষরমালার দহনে পুড়ে ছাই হয় সমস্ত স্বৈরাচার। 
“… কবি তাঁর সুর নিয়ে 
শ্বাস ফেলছেন জনতার মাঝখানে”

নামকরণের সার্থকতা: 

কবির কবিতার শব্দ জনমননে বারুদ হয়ে – প্রবেশ করে। সাধারণের প্রতিবাদ বিস্ফোরিত হয়-ধূলিস্যাৎ করে দেয় স্বৈরাচারী, বর্ণবিদ্বেষী, ফ্যাসিস্ট শাসকদের। এই মর্মসত্য প্রকাশেও কবিতাটি সার্থকনামা।

Leave a Comment