![]() |
ছাত্রছাত্রীদের জীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব |
ভূমিকা
কৌতুকশিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি ক্যাসেট-এ শুনেছিলাম, “আগে ছাত্রের হাতে থাকত পুস্তক, এখন থাকে ইষ্টক, লক্ষ মাস্টারের মস্তক।” এটা নিছক কৌতুক হলেও শুধু ছাত্রদের মধ্যে নয়, সমাজজীবনে সর্বত্র সৌজন্য ও শিষ্টাচারের একান্তই অভাব। এমনকি সৌজন্য-অসৌজন্য এবং শিষ্টাচার-ভ্রষ্টাচার-এর ভেদরেখা সম্বন্ধে শুধু ছাত্র কেন, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কতটা আছে-সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। তাছাড়া ছাত্রজীবন যেহেতু জীবনের ভবিষ্যৎ গঠনের একটি ধাপ তাই সেই সময়ে অর্জিত সৌজন্য ও শিষ্টাচার তার পরবর্তী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং যার ফলে একজন ছাত্র ভবিষ্যতের সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে।
সৌজন্য ও শিষ্টাচার কী
সুজনসুলভ আচরণ হল সৌজন্য এবং শিষ্ট বা ভদ্র আচরণ হল শিষ্টাচার। এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, কোন্টা সুজনের আচরণ বা কোল্টা ভদ্র আচরণ, আবার কোন্টা তা নয়। রবীন্দ্রনাথ সৌজন্য ও শিষ্টাচার সম্বন্ধে ‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থে ‘ভদ্রতার আদর্শ’ প্রবন্ধে দীপ্তির জবানীতে লিখেছেন, “কাব্যরাজ্যে কবির শাসন যেমন কঠিন-কবি যেমন ছন্দের কোনো শৈথিল্য, মিলের কোনো ত্রুটি, শব্দের কোনো রূঢ়তা মার্জনা করিতে চাহে না-আমাদের আচার-ব্যবহার বসন-ভূষণ সম্বন্ধে সমাজ পুরুষের শাসন তেমনি কঠিন হওয়া উচিত, নতুবা সমগ্র সমাজের ছন্দ এবং সৌন্দর্য কখনোই রক্ষা হইতে পারে না।”
সৌজন্য ও শিষ্টাচারের পরিবর্তন
পরিবর্তনশীল জগতে সব কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে পরিবর্তনশীল পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ফলে সৌজন্য, শিষ্টাচার, ভদ্রতা প্রভৃতি গুণাবলীরও রকমফের ঘটছে। অতীতে এইসব মানবিক গুণাবলীগুলি প্রকাশের মাধ্যমে একজন লোক ভদ্র বলে পরিচিত হত। অর্থাৎ অপরকে সম্মান দিয়ে নিজেকে সম্মানিত করবার মাধ্যমে যে আনন্দ, তা-ই সুজনের সৌজন্য নামে অভিহিত হত। কিম্বা, একজন অতিথিকে রূঢ় আচরণে অসম্মানিত করে আনন্দ পাওয়ার মধ্যে শিষ্টাচারের কোন লক্ষণ আছে বলে অতীতে মনে করা হত না। ফোনে নিমন্ত্রণ করে শিষ্টাচার দেখানোও অতীতে অসম্ভব ছিল, অসম্ভব ছিল শুধু চা খাইয়ে অতিথি বিদায় করা। কারণ, সে সময়ে সমাজে একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা, পরিমিতিবোধ, ধর্মাধর্মবোধ, কোন্টা আচরণীয়, কোন্টা আচরণীয় নয়-এটা সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে বিচার্য হত।
ছাত্রজীবনের গুরুত্ব
ছাত্রছাত্রীরা যেহেতু শিক্ষিত এবং শিক্ষার মধ্যে তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে ও তারা। যেহেতু যুবক-যুবতী তাই তাদের কাছে মনুষ্যত্ববৃত্তির স্বরূপ বেশি মাত্রায় থাকবে, এটা সকলেই কামনা করে। দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের মুখ আয়নায় ফেললে দেখে নিতে পারি, কিন্তু অন্তরকে দেখবার উপায় হল সৌজন্য, শিষ্টাচার-যার দ্বারা একজন মানুষের অন্তরস্থিত সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। ছাত্রজীবনে সুকুমার প্রবৃত্তিগুলির যে বৃহৎ সম্ভাবনা থাকে তা সৌজন্য ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। তৃতীয়ত, ‘An honest man is the noblest work of God’, সুতরাং একজন ছাত্র বা ছাত্রী সৎভাবে কাজ করে তাদের সৌজন্য ও শিষ্টাচারের মাধ্যমে পরমের আশীর্বাদ পেতে পারে। চতুর্থত, নীতিশ্লোকে আছে- ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং, বিনয়াদ যাতি পাত্রতাম, পাত্ৰতাৎ ধনমাপ্নোতি, ধনাৎ ধর্ম ততঃ সুখম্।’ পঞ্চমত, সৌজন্য ও শিষ্টাচার মানুষকে আন্তরিক ও সরল স্বভাবের করে তোলে। নেপোলিয়নও মনে করতেন, “The Greatest ornament of an illustrious life is modesty and humility, which go a great way in the character even of the most exalted princes”, তাই একজন ছাত্র-ছাত্রী সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিক হয়ে উঠতে হলে চাই সৌজন্য ও শিষ্টাচার। ষষ্ঠত, মেকলে মনে করতেন, আমাদের মানুষের জীবনে বিভিন্ন কাজে বদান্যতার প্রকাশ আমাদের ভদ্র করে তোলে। একজন মানুষ নিজে যেভাবে মানুষের ভালোবাসা পেতে চায়, সেভাবে অপরকে ভালোবাসাই হল শিষ্টাচার। এই শিষ্টাচার মানুষের মধ্যে আনে নিরপেক্ষতাবোধ ও স্বার্থত্যাগের মন্ত্র। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিষ্টাচার ও ভদ্রতা জাগ্রত হলে স্বার্থত্যাগকে মূল মন্ত্র হিসেবে মনে করে তারা সমাজে একজন হয়ে উঠতে পারে।
অন্তরায়
আভরণ যেমন দেহের শোভা, তেমনি সৌজন্য ও শিষ্টাচার আত্মার মাধুর্য। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেই আত্মার মাধুর্য সবক্ষেত্রে দুর্লভ। এই বস্তুবাদী সভ্যতায় কোন রকমে টিকে থাকার মন্ত্র-ই হল ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য। পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া ও একটা ভালো চাকুরি করে অর্থ উপার্জন করা ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেজন্য মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ততটা গুরুত্ব পায় না। একজন ছাত্রছাত্রী তার বন্ধুকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে কুণ্ঠাবোধ করে না, অভিভাবকের নির্দেশে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য মিথ্যা কথা বলতেও দ্বিধা করে না, বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকতে অস্বস্তিবোধ করে না। তাই তাদের কাছ থেকে শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ আশা করা বৃথা।
প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়
অথচ গান্ধীজির পৃথিবীব্যাপী খ্যাতির মূলে ছিল তাঁর ভদ্র ও মার্জিত আচরণ। যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে দিয়েছিল স্বতন্ত্র মর্যাদা। নেপোলিয়নের মতো বীরও একজন ভিক্ষুককে পথ দেখিয়ে তাঁর সৌজন্য ও শিষ্টাচারকে মেলে ধরেছিলেন। তাই এইসব মানুষের আদর্শের চর্চা ও অনুধ্যান করা ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজন। প্রয়োজন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঔদ্ধত্য ও অহমিকাকে বিসর্জন দেওয়া। কারণ তা শিষ্টাচার-এর পরিবর্তে ভ্রষ্টাচারকে প্রকাশ করে। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের সহনশীল মনোবৃত্তি থাকা দরকার। সহনশীল না হলে সৌজন্য ও শিষ্টাচার আসে না, অপরকে সম্মান দেবার প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয় না। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের শ্রমবিমুখতা ও আলস্য অসৌজন্য ও ভ্রষ্টাচারের আঁতুড় ঘর। সত্যের পথিকরূপে, অন্তরের স্বরূপকে প্রকাশ করে, সরলতা ও ভদ্রতার সঙ্গে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে ছাত্রছাত্রীদের সুজন ও সদাচারী হয়ে ওঠা সমাজের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন।
উপসংহার
তোষামোদ বা চাটুকারবৃত্তি কিন্তু শিষ্টাচারের পরিপন্থী। অতিরিক্ত বিনয়ও প্রতিবাদী চেতনাকে রুদ্ধ করে। আর এগুলো সৌজন্যের লক্ষণও নয়। আসলে সততার দ্বারা, অপরকে সম্মান দিয়ে সম্মান পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ বা মাধুর্য, তার আস্বাদ যদি ছাত্রছাত্রীরা একবার পায়, তাহলে সে পথ থেকে খুব একটা বিচ্যুত হবে না তারা। তাই ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার-ই তার পরিচয়, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হোক্ ছাত্রছাত্রীরা-এই আশা করতে আপত্তি কোথায়?