জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রচনা

জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রচনা
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রচনা

ভূমিকা

মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু সমস্যা জর্জরিত বিংশ শতাব্দীর মতোই একবিংশ শতাব্দীর এক অন্যতম সমস্যা পরিবেশ দূষণ। পরিবেশের জল, হাওয়া, মাটি এগুলি যেমন উপাদান; তেমনই গাছ, পশুপাখি, মানুষ এগুলিও এক একটি উপাদান। আর এইসব উপাদানগুলি যখন একত্রে অথবা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দূষিত হয় তাকেই বলে পরিবেশ দূষণ। এই দূষণের ফলে জল, বায়ু, শব্দ সবই দূষিত হচ্ছে যার ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যাহত হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য কী

‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ কিংবা ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম্’-এসব কথা বহু প্রচলিত। কিন্তু বর্তমানে আমরা জনস্বাস্থ্য নিয়ে প্রায় কোনো চিন্তা করি না বললেই চলে। এ বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা এতই স্বার্থকেন্দ্রিক যে সমষ্টিগত স্বার্থ কিভাবে রক্ষিত হবে, তা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ আমাদের নেই। 

পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য

সমগ্র জনমানসের স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে জনস্বাস্থ্য বলা যেতে পারে। অন্যদিকে যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা জনগণকে সুস্থ রাখে, তাকেই বলা যায় অনুকূল পরিবেশ। মুক্ত বায়ু, বিশুদ্ধ জল, উন্নত চিকিৎসা, সার্বিক সচেতনতা সব মানুষই পেতে চায়। কারণ মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে এগুলি যুক্ত। পরিবেশ যদি দূষিত হয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য যদি রক্ষিত না হয়, অশিক্ষা-কুশিক্ষা যদি মানুষকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে তাহলে জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হয়। আর এই কারণেই জনস্বাস্থ্যের আলোচনা বিশেষ প্রয়োজনীয়। তাই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দুটি শব্দ।

জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়ার কারণ

আজ আমাদের বেশির ভাগ রোগের কারণ দূষিত জল ও বায়ু। যে নদীকে কেন্দ্র করে মানুষ একদিন সভ্যতা গড়ে তুলেছিল সেই নদীতে আজ জমেছে সভ্যতার উদ্বৃত্ত, ফলে জল হয়েছে দূষিত। এই দূষিত জল শরীরকে অসুস্থ করছে। অন্য দিকে মুক্ত বায়ুর অভাব মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্ম দিচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সি এফ সি) ইত্যাদির মতো দূষিত গ্যাস প্রতিদিন আবহাওয়াকে দূষিত করছে। সেই সঙ্গে কলকারখানার ধোঁয়া ও উত্তাপ আবহাওয়াকে করছে কলুষিত। এরপর আছে ছত্রাক ও কীটনাশক। সবুজ বিপ্লবের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে নানা বিষাক্ত পদার্থ-যা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক। মৃত্তিকা দূষণ আজ পৃথিবীর তথা ভারতের এক ভয়াবহ সমস্যা। রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। বিস্ফোরণের ফলে ভূগর্ভস্থ স্তরে মাটি দূষিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাটি তার নিজের গুণাগুণ সম্পূর্ণ হারাবে। তাছাড়া পরমাণু বিস্ফোরণের ফলে ভূগর্ভস্থ জলে পরমাণু দূষণ ঘটায়। এর ফলে জৈবিক খাদ্যশৃঙ্খলে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ তেজষ্ক্রিয়তা ডি.এন.এ-কে ভেঙে দেয়। এমনকি বিস্ফোরণের ফলে বুদ্ধতাপের সৃষ্টিতে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়েও যায়। দ্বিতীয়ত, আগামী শতাব্দীতে ভারতবর্ষ জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম স্থান অধিকার করবে। জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত করছে। জনবিস্ফোরণের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জল-মাটি-বায়ুর ওপর পড়ছে প্রচণ্ড চাহিদার চাপ। এই চাপ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্বাস্থ্যের সংকট। তৃতীয়ত, ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষ এখনো নিরক্ষর। নিরক্ষরতাও জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়ার অন্যতম কারণ। শিক্ষা আনে সচেতনতা, তাই যথার্থ শিক্ষার অভাবে মানুষ তাদের নিজ নিজ স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন হতে পারেনি। চতুর্থত, আধুনিক মানুষ বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ক্রমশ পরিণত হচ্ছে যন্ত্রে। যন্ত্রের মতোই তারা কৃত্রিম হয়ে পড়ছে। এই যান্ত্রিকতা, শ্রমবিমুখতা, নিয়মিত শরীরচর্চার অভাব তাদের স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত করছে। পঞ্চমত, মানুষের কু-অভ্যাস অর্থাৎ যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা, স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চলা, রান্নাবান্নার পদ্ধতি প্রভৃতি জনস্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। ষষ্ঠত, আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। কিন্তু শিশুর স্বাস্থ্য, তাদের নীরোগ শরীর, তাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সবক্ষেত্রে ভাবছি না। তা না হলে ভারতবর্ষে এত শিশু শ্রমিক কেন, কেনই বা তারা পরিণত হওয়ার আগে রোগগ্রস্ত হচ্ছে? সুতরাং শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে অবহেলা আমাদের অগ্রগতির পরিপন্থী।

প্রতিকার

জনস্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে গেলেই প্রথম যেটি প্রয়োজন সেটি হল আমাদের জনবিস্ফোরণ কমানো। ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি’-এই কথা ভেবে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। এজন্য প্রয়োজন আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতকে কাম্য জনসংখ্যায় নামিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, পরিবেশ দূষণের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে না পারলে জনস্বাস্থ্যের চিন্তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। এজন্য প্রয়োজন গাছ কাটা বন্ধ করা, বনসৃজন করা, পতিত জমির উন্নয়ন, জলবিভাজিকা নিয়ন্ত্রণ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রভৃতির দ্বারা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা। ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’, ‘গাছ লাগাও দেশ বাঁচাও’ প্রভৃতি মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে সবাইকে। প্রকৃতিকে সবুজ রেখে, বৃষ্টির প্রাচুর্য বাড়িয়ে তোলা, বর্জ্য পদার্থকে বৈজ্ঞানিক প্রথায় অন্য পদার্থে পরিণত করে তা আবার মানুষের প্রয়োজনে লাগানো যাতে জনস্বাস্থ্য রক্ষিত হবে। দূষিত জলকে পানযোগ্য করে তুলতে হলে উপযুক্ত পরিস্রাবণ দরকার। মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করা, গাড়ির হর্ণের শব্দাঙ্ক হ্রাস করে শব্দদূষণ রোধ করা একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি দরকার পরিবেশ সচেতনতা। তৃতীয়ত, আমাদের দেশের বেশির ভাগ নিরক্ষর মানুষ যেখানে অশিক্ষা, অজ্ঞতা, কুসংস্কারে ভুগছে তাদের স্বাস্থ্যচেতনায় উজ্জীবিত করতে গেলে প্রয়োজন সার্বিক সাক্ষরতা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা যেমন অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হবে, তেমনি হবে স্বাস্থ্য সচেতন। যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করলে কি ক্ষতি হয়, ধোঁয়াহীন চুল্লিতে রান্না করলে কি লাভ হয়-এসব সম্বন্ধে সচেতন হবে। চতুর্থত, দেশের আপামর মানুষকে যদি বিজ্ঞানমনস্ক করে না তোলা যায়, তারা যদি ডাইনি সন্দেহে কাউকে পিটিয়ে মারে, সাপে কামড়ালে ওঝার কাছে যায়, জন্ডিস হলে হাত ধোয়া জল খাওয়ায়-তাহলে জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবে বৈ কি!

উপসংহার

একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও আজ আমরা যদি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে নির্বিকার থাকি, তাহলে আগামী প্রজন্ম এক বিরাট সংকটের মধ্যে পতিত হবে-একথা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে কি করে মুক্ত বায়ু, সুঠাম স্বাস্থ্য ও বলের অধিকারী আমরা হতে পারি। এজন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন করার জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং শুধু তা করলেই হবে না, সর্বোপরি প্রয়োজন এইসব কাজের দৈনন্দিন মূল্যায়ন। সুখের বিষয়, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছেন। মনে রাখতে হবে, যারা পরিবেশকে দূষিত করে জন- স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেন তারা সমাজের শত্রু।

Related keyword
পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য pdf
পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্য রচনা
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সপ্তম শ্রেণী প্রশ্ন উত্তর
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার রচনা
পরিবেশ সচেতনতা রচনা pdf
পরিবেশ ও আমরা প্রবন্ধ রচনা
পরিবেশ রক্ষায় মানুষের ভূমিকা রচনা
প্রাকৃতিক পরিবেশ রচনা

Leave a Comment