জাতীয় সংহতি প্রসারে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা রচনা

জাতীয় সংহতি প্রসারে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা রচনা
জাতীয় সংহতি প্রসারে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকা রচনা

ভূমিকা

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য হল ভারতবর্ষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এখানে ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। এদেশে যুগ যুগ ধরে কত জাতি-শক, হুন, পাঠান, মোঘল, ইংরেজ এসেছে এবং তারা আবার ফিরে গেছে অথবা কেউ কেউ ভারতীয় হয়ে গেছে। আবার এই ঐক্যের উপর নানা বাধা নানা দিক থেকে এসেছে। সংহতিকে বিনষ্ট করার জন্য আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, কিন্তু ভারতবর্ষের সংহতি বিনষ্ট হয়নি। তাই এই জাতীয় সংহতিকে উপলব্ধি করে সেই সংহতি প্রসারে ছাত্রছাত্রীদের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জাতীয় সংহতির ভিত্তি

মূলত কোনো একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষজন যদি একই ভাষায় কথা বলে, একই ধর্মাবলম্বী হয়, তাদের নিয়ে গঠিত হয় একটি জাতি বা Nation । এই জাতির মধ্যে পারস্পরিক সুশৃঙ্খল বোঝাপড়া ও আত্মার বন্ধনেই স্থাপিত হয় জাতীয় সংহতির সোপান। এই সংহতির মূল ভিত্তি হল-রাজনৈতিক অখণ্ডতা, ভারতের অখণ্ড ইতিহাস এবং সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যে ঐক্য স্থাপন। তাই ভারত গণতান্ত্রিক উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোয় পরিচালিত। এমনকি আমাদের ইতিহাস কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা কেবল একটি জাতির ইতিহাস নয়, আমাদের ইতিহাস শুধুমাত্র বর্তমান ভারতের ইতিহাসও নয়, আমাদের ইতিহাস সমস্ত ভারত ভূখণ্ডের এক অখণ্ড ও সুপ্রাচীন মহান ইতিহাস।

জাতীয় সংহতি প্রসারের প্রয়োজন

ভারতের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও বিরাটত্বই জাতীয় সংহতি বিনষ্টির কারণ। পরাধীন ভারতবর্ষে জাতীয় সংহতির ভাবধারা প্রবল মাত্রায় পুঞ্জীভূত ছিল কারণ সে সময় ইংরেজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ইংরেজ শাসনকার্য পরিচালনার প্রয়োজনে সেই সংহতি বিনষ্ট করার কাজে তৎপর হয় এবং তারই প্রসারের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী ফল দ্বিজাতিতত্ত্ব। স্বাধীন ভারতবর্ষে মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রভৃতি জাতীয় সংহতি বিনষ্টির পথকে প্রশস্ত করে। যেমন, ভারতের বিভিন্ন স্থানে মৌলবাদীরা বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে এবং ধর্মের নামে মোহ যেভাবে তাদের গ্রাস করেছে ও সেই মোহ কিছু মানুষকে যেভাবে উৎসাহিত করেছে কিম্বা রাজনীতি যেভাবে ধর্মকে মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছে তাতে জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হওয়ায় তা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজ গণপরিষদ ভারতের হিন্দি ভাষাকে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি এবং ছেচল্লিশটি ভাষাকে দিয়েছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি-যা অন্যান্য ভাষাভাষী, এমনকি অহিন্দি ভাষীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় জাতীয় সংহতি প্রসারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তৃতীয়ত, সম্পদের অসম বণ্টন, বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক সমস্যা প্রাদেশিকতার জন্ম দেওয়ায় জাতীয় সংহতি রক্ষার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চতুর্থত, আমাদের কিছু মানুষের বিচ্ছিন্ন মানসিকতাকে উসকে দিচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী চক্র তথা বিদেশি শক্তি। সেক্ষেত্রেও জাতীয় সংহতি রক্ষার কাজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

ছাত্রছাত্রীদের করণীয়

বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা যেহেতু ভবিষ্যৎ দেশের নাগরিক এবং তারা যেহেতু তরুণ ও নবপ্রজন্মের বার্তাবহ, তাই তারা যদি জাতীয় সংহতি প্রসারে সচেতন না হয় তাহলে তাদের অসংহতি জনিত দুর্দশার ফল ভোগ করতে হবে। তাই তাদের উপলব্ধি করতে হবে জাতীয় সংহতি দেশের পক্ষে অমূল্য সম্পদ এবং তাকে রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংহতি ফিরিয়ে আনার সোপান হল সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাসের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করা। তৃতীয়ত, কোনো মৌলবাদ যাতে না মাথা চাড়া দিতে পারে সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ছাত্রছাত্রীকে উপলব্ধি করতে হবে, “ধর্মের নামে মোহ এসে যারে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে”। চতুর্থত, আঞ্চলিক সমস্যা নিশ্চয় থাকবে কিন্তু সেই সমস্যা জাতীয় সংহতি যাতে বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন হতে হবে। কারণ ঐক্যই সম্পদ, অনৈক্যই বিপদ। পঞ্চমত, দেশে সম্পদের যাতে সুষম বণ্টন হয় ভেদাভেদ যাতে সংহতি রক্ষার কাজকে ব্যাহত না করে সে বিষয়ে প্রতিবাদী চেতনা গড়ে তুলতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। ষষ্ঠত, বিভিন্ন কুটকৌশলী রাজনৈতিক দলের কুচক্রীদের হাতে আমাদের জাতীয় সংহতি যাতে বিনষ্ট না হয় সে বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন হতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের জানতে হবে আইনের চোখে সকলে সমান-একথা শুধু সংবিধানের বিষয় নয়, বাস্তবিক জীবনে তা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সপ্তমত, ভাষাগত বিভেদ ও ভাষার গুরুত্ব বিষয়ে কোনো সংকীর্ণ মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। কোনো ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা বলে চালিয়ে দিলে অন্য ভাষাভাষীরা বিদ্রোহী হতে পারে-একথা উপলব্ধি করতে হবে ছাত্রছাত্রীদের।

উপসংহার

ছাত্রছাত্রীদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পনেরই আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারি, দোসরা অক্টোবর, তেইশে জানুয়ারি প্রভৃতি দিনগুলি শুধুমাত্র ছুটির দিন বা পিকনিকের দিন বা বেড়ানোর দিন নয়, যে রক্ত ও যে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা এসেছে তা উপলব্ধি করে সেই দিনগুলি উদ্যাপনের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে দেশের সংহতি রক্ষিত না হলে নিজেদের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। তাই ছাত্রছাত্রীরা যেন মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারে-

এসো হে আর্য এসো অনার্য হিন্দু মুসলমান
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রীস্টান 
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন, ধর হাত সবাকার 
এসো হে পতিত, কর অপনীত, সব অপমান ভার।

Leave a Comment