![]() |
দাও ফিরে সে অরণ্য রচনা |
ভূমিকা
‘এস নীপবনে, ছায়াবীথি তলে,/এস কর স্নান,/নব-ধারা জলে’। প্রকৃতির এই নব-ধারা জলে স্নান করার জন্য কবি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন। কেননা, এই যান্ত্রিক জীবন কবিকে পীড়া দিচ্ছে, কৃত্রিমতার নাগপাশে স্বাভাবিক জীবনের প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হচ্ছে না। অথচ স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বাভাবিকতা হল জীবনের ধর্ম। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানশক্তির প্রভাবে দীপ্যমান আধুনিক নগর- সভ্যতা ও অতীতের আরণ্যক সভ্যতার মধ্যে আজ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আধুনিক সভ্যতা আমাদের দিয়েছে আরাম কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সুখ ও শান্তি। তাই ভাবতে হচ্ছে, নতুন করে কীভাবে এই কৃত্রিম সভ্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যন্ত্র ও নগর সভ্যতার প্রবল অগ্রগতি সম্পর্কে এজন্যই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বারবার সতর্কবাণী ধ্বনিত হয়েছে, উচ্চারিত হয়েছে-‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’।
সভ্যতার সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্ক
সভ্যতার সঙ্গে অরণ্যের সম্পর্ক অপত্যের। বস্তুত অরণ্যই সভ্যতার প্রসূতি। আদিম মানুষ গুহাবাসী বনবাসী ছিল বলে নয়, সভ্যতার প্রথম স্মারক যে অগ্নি, অরণ্যই সেই প্রমিথিউস্। শমীবৃক্ষের ঘর্ষণে মানুষ আগুন আবিষ্কার করেছিল। এরপর কৃষি। এ-ও অরণ্যেরই অবদান। ফল মাটিতে পড়ে জল পেয়ে বীজ থেকে আবার বৃক্ষ হয়, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ঐ শিক্ষা মানুষ গাছের কাছেই পেয়েছে। চাষ থেকে মাথার উপর বৃক্ষপত্রের ‘বাস’ (হোম/Home) কিংবা বল্কলের পরিধান সবই তো অরণ্য জননীর দান। তারপর মানুষের যে ‘বেদ’ অর্থাৎ বিদ্যা তাও এনে দিয়েছে তপোবন নামে পরিপাটি অরণ্য। সভ্যতার উন্মেষ শুধু নয়, বিকাশও হয়েছে আরণ্যক অভিজ্ঞানে।
নগর সভ্যতার মূল লক্ষ্য
বিজ্ঞান-নির্ভর আধুনিক নগর-সভ্যতার মূল লক্ষ্য জীবনকে আরামদায়ক করা, আমাদের কায়িক পরিশ্রম লাঘব করে জীবনকে বেগবান করা। তথাকথিত এই উন্নয়নশীল সভ্যতার প্রায় সব কিছুই কিন্তু বাহ্যিক চাকচিক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অদ্ভুত উন্নতি হয়েছে, দূরের পৃথিবী আমাদের ঘরের কাছে এসেছে, মানুষ তার আশ্চর্য বুদ্ধিবলে দূরকে নিকট করেছে-এসব কথা আমরা উঠতে বসতে বলে থাকি। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এসব কিছুই বাহ্যিক উন্নতি। গতিবেগ জীবনকে এত জোরে ছুটতে বাধ্য করছে যে, সে আর এক মুহূর্তও জিরোবার ফুরসৎ পাচ্ছে না। এখানেই শেষ নয়, বৈষয়িক উন্নতির দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের স্বার্থপর, কৃত্রিম ও পরশ্রীকাতর করে তুলছে। সম্পদ- আহরণ ও ভোগ-বিলাসের নেশায় আমরা এত বেশি প্রমত্ত হয়ে পড়ছি যে, লোভ হিংসা ও কপটতা অতি সহজে আমাদের গ্রাস করছে। সময়-সময় যেন দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে আমরা উন্মাদের মতো ছুটছি। ফলে, বাড়তি যে গতিবেগ আমরা বিজ্ঞানের কাছ থেকে পাচ্ছি তা আমাদের কোনো মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে না, অনির্দিষ্ট এবং হয়তো-বা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত কোনো দিকে চালিত করছে। অসহায় আমাদের অবস্থা।
আধুনিক সভ্যতার কুফল
ধ্বংসকারী এই সভ্যতার ভয়ংকর চেহারা রবীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন ‘রক্তকরবী’র রাজা চরিত্রে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে অরণ্য বিনাশের সর্বনাশা ট্রাজেডি দেখিয়ে নব্য সভ্যতার অসভ্যতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ইউরোপীয় মনীষী লেখকের কাছ থেকেও Far From the Madding Crowd-এর মতো উপন্যাসে অরণ্যের কাছে সভ্যতার আত্মবিনাশ রোধের আবেদন আমরা পেয়েছি। কিন্তু ‘কাকস্য পরিবেদনা’। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির আগ্রাসী প্রতিযোগিতা এবং বিজ্ঞানের কাছে পাওয়া সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সুখ ও আরাম অরণ্যের রামকে কেবল আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণে রেখে ঘৃণিত রাবণকেই জীবনাচরণে গ্রহণ করছে। প্রতিদিন অরণ্য ও গ্রাম বিনষ্ট হয়ে প্রসারিত হচ্ছে নগর, ‘যত লৌহ, লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’। ক্যারিয়ার-সর্বস্ব মূল্যবোধহীন মানবিক শিক্ষাবর্জিত যে ভোগী প্রযুক্তিবিদ্-প্রজন্ম বিশ্বের নাগর (বুর্জোয়া) নায়কগণ নির্মাণ করছেন তারা জন্ম দিচ্ছে আনন্দহীন, সৌন্দর্যবোধহীন, মমত্বহীন একটি স্নায়ুরোগী ও মনোরোগী সভ্যতার। তাই তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা মানুষকে আরাম দিচ্ছে (গান্ধীজি যাকে বলেছিলেন হারাম), দিচ্ছে না সুখ, পরিবেশ দূষণের বিষ দিচ্ছে, দিচ্ছে না নীলকণ্ঠ পাখির সেই শিস, যা মানুষকে নিয়ে যেতে পারে সেই ‘রূপনারায়ণের কূলে’, যা মানুষকে দেয় মনুষ্যত্বের
যান্ত্রিকতার প্রতিক্রিয়া
আনন্দ ও স্বাধীনতা। নিজের হাতে আমরা কত কী গড়ে তুলছি, নিজের শক্তিকে কত দ্রুত আমরা বহুগুণিত করছি। অথচ চরম আক্ষেপ ও আশঙ্কার কথা এই যে, আমরাই আজ আমাদের হাতে-গড়া যন্ত্রের হাতে বন্দী। যন্ত্র আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করছে না, মুষ্টিমেয়কে অমিত শক্তির অধিকারী করছে। যন্ত্রশক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ নিজেই হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। মানুষে-মানুষে এবং মানুষে-প্রকৃতিতে বিচ্ছেদ বাড়ছে এবং স্বাভাবিকতার বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে কৃত্রিমতা। বস্তুত মানবিক-শক্তিতে পৃথিবী যত দীর্ণ হচ্ছে, তার মৃত্যুঘাতী অস্ত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ততই হচ্ছে আকাশস্পর্শী। এই ‘আগুন নিয়ে খেলা’ বন্ধ হবার কোনো আশা নেই। শক্তিদন্তী মানুষ ইট-পাথরে গড়া বিরাট প্রাসাদের মধ্যে বসেও নিজেকে অসহায় ও অসুখী ভাবতে বাধ্য। দুর্বল কোনো মুহূর্ত অতি সাধারণ কোনো মানুষেরও মনে হতে পারে, এর চেয়ে প্রাচীন যুগের মুক্ত, স্বাভাবিক ও নিরুপদ্রব জীবন অনেক সুখের।
উপসংহার
আমাদের চারপাশের জগৎ ও জীবন দেখে আশঙ্কা হয় আমাদের বোধ হয় আর ফেরার পথ বন্ধ। কারণ ‘চিচিং ফাঁক’ ভুলে গেছি, এখন কেবল তাই ‘আলু ফাঁক’, ‘কুমড়া ফাঁক’ প্রভৃতির চিৎকার করতে পারি মাত্র। তবে ভারতীয় দর্শন অস্তিত্ববাদে বিশ্বাসী, নেতিবাচক মনোভাবের স্থান সেখানে কম। তাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবতে হবে, তারও চেয়ে বেশি ভাবতে হবে সকলকে। গ্রাম ও শহরের ভারসাম্য আনতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বন সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ যেমন করতে হবে তেমনি জাতীয় জীবনের গতি যাতে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হয় তাও দেখতে হবে। তাহলে আর কবির মতো আক্ষেপ করতে হবে না-‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’।