পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি রচনা

পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি রচনা
পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বিকল্প জ্বালানি রচনা

ভূমিকা

বর্তমান সময়ে সভ্যতার অগ্রগতিতে পেট্রোপণ্য মহার্ঘ্য। তাই যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার অগ্রগতিতে পেট্রোপণ্যের চাহিদার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে- বর্তমান দিনে সভ্যতার অগ্রগতিতে অর্থনীতির অনেকটাই খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়ামের যা পেট্রোপণ্যের ব্যবহারকারীদের কাছে সুখের খবর নয়। তাছাড়া পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানেই জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা। সেক্ষেত্রে পেট্রোপণ্যের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি-এই অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও সরকারকে বিভিন্ন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পেট্রোলিয়াম কী

উপর নির্ভরশীল। ‘পেট্রোলিয়াম’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘petra’ থেকে যার অর্থ হল পাথর এবং ‘অলিয়াম’ কথাটির অর্থ হল তেল। আজ থেকে পাঁচ ছয় কোটি বছর আগে মাটি ও বালি জমে সৃষ্টি হয় পাললিক শিলা। বিভিন্ন কালে পাললিক শিলা তৈরির সময় প্রাণীজ ও উদ্ভিজ দেহাবশেষ পাললিক শিলার বিভিন্ন স্তরে সঞ্চিত থেকে যায়। কালের বিবর্তনে পাললিক শিলার মধ্যবর্তী স্তরগুলিতে সঞ্চিত প্রাণীজ ও উদ্ভিজ দেহাবশেষের নানান বিবর্তন ঘটে, সৃষ্টি হয় হাইড্রোজেন ও কার্বনঘটিত যৌগ হাইড্রোকার্বন। পরবর্তীকালে ভূগর্ভের তাপ শিলাস্তরের চাপের ফলে হাইড্রোকার্বন পরিণত হয় তরল তেল জাতীয় পেট্রোলিয়াম পদার্থে।

ব্যবহার

পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার হয় বহু ক্ষেত্রে। গাড়ির জ্বালানি থেকে শুরু করে, রাসায়নিক সার, পরিধানের টেরিলিন, পলিয়েস্টার, ক্যাশমিলন, প্রসাধন সামগ্রী, কেরোসিন, রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান হিসাবে পেট্রোলিয়ামের প্রয়োজন। পেট্রোলিয়ামের প্রধান ব্যবহার জ্বালানি শক্তির উৎস হিসাবে বিদ্যুৎ ও শক্তি উৎপাদনে। পেট্রোলিয়াম ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাসও পেট্রোলিয়াম খনি থেকে উত্তোলিত হয়-তাও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক রাজ্যে অটো প্রাকৃতিক গ্যাস-এর দ্বারা চালিত হয়।

বিকল্প শক্তির গুরুত্ব

পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত শক্তি এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তি, পারমাণবিক শক্তি, বায়ুশক্তি, কোটাল শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ স্রোতশক্তি এবং জীবভর-ভিত্তিক বিভিন্ন শক্তির কথা ভাবা যেতে পারে। কেননা একদিকে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিজ ভাণ্ডার পৃথিবীতে ফুরিয়ে আসছে অন্যদিকে পৃথিবীব্যাপী তার চাহিদা বাড়ছে, ফলে সেই ভাণ্ডার শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। ঠিক এ কারণেই বিকল্প জ্বালানি সন্ধানের প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট। জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ, পেট্রোপণ্য প্রভৃতি চিরাচরিত শক্তি যতই শেষ হয়ে যাচ্ছে ততই জ্বালানি হিসেবে বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে বিজ্ঞানীরা নানা উপায়ের কথা বলছেন।

সৌরশক্তি

সৌরশক্তিকে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার যুক্তিযুক্ত এবং তা পরিবেশ বান্ধব (Eco- friendly)। যেমন, সোলার কুকার-এর দ্বারা রান্নার কাজ করা যায়। সূর্যের রশ্মির তাপশক্তিকে ব্যবহার করে যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। শুধু রান্নার কাজে নয়, ইলেকট্রিক বাতি জ্বালানো, টিভি, ফ্রিজ, পাখা, জল তোলার পাম্প চালানোর কাজে সৌরশক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে-যার ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে।

পারমাণবিক শক্তি

পারমাণবিক শক্তিকেও বিকল্প শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও দেশের সামরিক অস্ত্র, সাবমেরিন এবং যুদ্ধ জাহাজ পরিচালনার কাজে এই শক্তিকে ব্যবহার করা হয়। তবে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে ক্ষতিকারক পারমাণবিক শক্তি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি হয় তা যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা ও তজ্জনিত বিপুল খরচ-এর কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে চেরনোবিল দুর্ঘটনা কিম্বা সম্প্রতি জাপানে সুনামির ফলে উদ্ভুত ফুকুশিমার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

জীবভর-ভিত্তিক শক্তি

জীবভর-ভিত্তিক শক্তিকে পেট্রোপণ্যের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেমন, ‘পেট্রোপ্লান্টস’। এমন ধরনের ৩৮৫টি প্রজাতির উদ্ভিদকে সনাক্ত করা | জীবভরভিত্তিক শক্তি যার মাধ্যমে প্রাপ্ত তরল হাইড্রোকার্বনকে ব্যবহৃত তরল জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই ধরনের উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত হাইড্রোকার্বনকে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনে রূপান্তর করা সম্ভব। ইউফোরবিয়েসী, স্যাপোটেসী, অ্যাপোসাইনেসী প্রভৃতি গোত্রের কতকগুলি উদ্ভিদ প্রজাতির তরুক্ষীর বা ল্যাটেক্স থেকে পরিশোধনের মাধ্যমে পেট্রোল, গ্যাস, ন্যাপথা, কেরোসিন ইত্যাদি উৎপাদন করা সম্ভব এবং জ্বালানি হিসেবে তা পেট্রোলের বিকল্প হতে পারে। এছাড়া জৈব জ্বালানি হিসেবে ইথানল, মিথানল-এর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। ইথানল ব্যবহার করে ব্রাজিলে গাড়ি চালানো সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে বায়োগ্যাস বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কেননা গবাদি পশুর বিষ্ঠা থেকে যে গ্যাস উৎপাদিত হয় তার দ্বারা রান্নার কাজ করা সম্ভব। সেইসঙ্গে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ বায়োটেকনোলজিকে কাজে লাগিয়েছে এবং ফারমেনটেশন পদ্ধতির উন্নতিকরণের মাধ্যমে আখ থেকে প্রচুর অ্যালকোহল উৎপাদন করছে। এই অ্যালকোহলকে পেট্রোলের বিকল্প শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

উপসংহার

ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে পেট্রোপণ্যের বিকল্প জ্বালানি প্রস্তুত করার জন্য যে খরচ তা আপামর জনসাধারণ বহন করতে পারবে কিনা তা বিবেচনা করতে হবে। সেইসঙ্গে পেট্রোপণ্যের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং যথাযথ ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। একথা ঠিকই, চাহিদা অনুযায়ী যোগান হবে-প্রচলিত ধারণা থেকেই বিকল্প ধারণার জন্ম নেবে। এজন্য প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট সকলের সদিচ্ছা এবং মানুষের অতিরিক্ত ভোগেচ্ছা-র প্রশমনও জরুরি।

Leave a Comment