প্রতিযোগিতার সুফল এবং সংকট রচনা

প্রতিযোগিতার সুফল এবং সংকট রচনা
প্রতিযোগিতার সুফল এবং সংকট রচনা

ভূমিকা

বিশ্বায়ন উত্তর কালে সমগ্র বিশ্ব যেহেতু একটি বাজার সেহেতু বাজারে নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতেই হয়। তাছাড়া টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম যদি ভূমিকা জীবনধারণের অন্যতম শর্ত হয় তাহলে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ভাব আসবেই। কথায় বলে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ এই পৃথিবী ভোগ করতে হলে নিজেকে যোগ্য করতে হবে। যোগ্য করতে গেলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। আর প্রতিযোগিতার আসরে নিজেকে প্রমাণ করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই সেক্ষেত্রে সুফল ও সংকট আসবে। বর্তমানে বিশ্বায়ন উত্তরকালে প্রতিযোগিতার সুফলের থেকে সংকট যে বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে তা বলা, বাহুল্যমাত্র। 

প্রতিযোগিতা

‘প্রতিযোগিতা’ শব্দের উৎস হল সং প্রতিযোগিন [প্রতি যুজ্ + ইন্]+ তা। যার অর্থ হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগীর ভাব। প্রতিযোগীর ভাব থাকলে সৃষ্টি হয় সমকক্ষতা বা বিরুদ্ধ মনোভাব। প্রতিযোগিতার মধ্যে সৃষ্টি হয় ঈর্ষা। অবশ্য এই ঈর্ষা সুমহতী-যেমন ‘দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান’। আবার ঈর্ষা যদি অপরকে হীন বা দুর্বল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ধাবমান হয় তখন তা হয়ে ওঠে বিধ্বংসী। শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী প্রথম স্থানাধিকারীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পরের বছর প্রথম হলে তাতে প্রতিযোগিতার সুফল-ই সূচিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় স্থানাধিকারী যদি প্রথম স্থানাধিকারীকে ভয় দেখিয়ে কিম্বা অন্য কোনো উপায়ে তার মনোবল ভেঙে দিয়ে নিজেকে প্রথম বলে প্রতিপন্ন করে তাহলে সৃষ্টি হয় সংকট, কেননা তা অশুভ। অপরের শক্তি ক্ষয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলে সংকট তো সৃষ্টি হবেই। আর যদি নিজেই পূর্বাপেক্ষা আরো শক্তি সঞ্চয় করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি তাহলে প্রতিযোগিতার সুফল আসবেই এবং তা হবে কল্যাণমুখী ও ইতিবাচক।

সুফল

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিযোগিতার বাজারে লড়াইর মনোভাব থাকে বলেই বাজারে নিজের অস্তিত্ব ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। যোগ্যতা প্রমাণের জন্য যাচাইর ক্ষেত্র হল প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। তাই প্রতিযোগিতার সুযোগ আছে বলেই অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। আবার সামাজিক ক্ষেত্রে সংস্কার দূরীভূত হয়, সমাজজীবনে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ফিরে আসতে পারে। সমাজের একটি ভাল দিকের প্রতিফলন ঘটলে, তা দেখে অন্যরাও – তাতে আকৃষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের কল্যাণকর প্রতিযোগিতা সমাজে থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তার দ্বারা অনেক সুফলও পাওয়া যায়। সেজন্য শিল্পপতিদের প্রতিযোগিতায় ব শিল্প সম্ভাবনা বাড়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সাফল্য আসে। ভাল ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভর্তি হতে পারে। চাকরির ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমাণ করে চাকরিলাভের সুযোগ আসে। সর্বোপরি সমাজে ও অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা রয়েছে বলেই সমাজের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।

সংকট

বিশ্বায়নের ফলে আজকের একবিংশ শতাব্দীর মানুষ বাজার অর্থনীতির অক্টোপাশে আবদ্ধ হয়ে বড়ো বেশি কৃত্রিম ও স্বার্থসর্বস্ব জীবনকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হয়েছে। বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির ঠেলায় প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে গিয়ে মানুষ তার চিরন্তন চারিত্রিক সম্পদগুলিকে (ত্যাগ, ধৈর্যশক্তি, মায়া-মমতা-ভালোবাসা, শ্রমশীলতা) হারিয়ে ফেলেছে বা অবক্ষয়িত করেছে। আজ ভারতে • একটি শিশু জন্ম নেবার পর থেকেই সে জানছে প্রতিবেশী দেশ তার শত্রু। আবার উচ্চাশার রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ইঁদুরদৌড়ে সামিল করে দিচ্ছেন। নির্মম অসম প্রতিযোগিতায় নেমে শিশুমন দিশেহারা হয়ে পড়ছে। বর্তমান কর্পোরেট জীবনে বিজয়ীর প্রতিষ্ঠা আর বিজিতের অপমৃত্যু। সেকেন্ড হওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, যত কৃতিত্ব ফার্স্ট হওয়ার মধ্যে। প্রতিযোগিতায় অপরের ক্ষতি করে মানুষ আনন্দ পাচ্ছে। আবার প্রতিযোগিতায় হেরে মানুষ যেমন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, তেমনই চেয়ার টেবিল ভেঙে, মানুষকে আহত করে তারা আনন্দ প্রকাশ করে। বিষম প্রতিযোগিতায় মানুষ দিশেহারা হয়ে উন্মত্ত খ্যাপা কুকুরের মতো লোভ, লালসার, ভোগের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় ও শঙ্করের কথা, যারা লোভের বশবর্তী হয়ে কীভাবে ছুটে চলেছিল।

সংকট নিরসন

প্রাচীনকালে ছাত্রদের অধ্যয়নই ছিল তপস্যা। গুরুগৃহে তাদের শিক্ষা অর্জন করতে হত- সে শিক্ষা নৈতিক শিক্ষা। এখন সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। সব বাবা-মা চায় তার ছেলে পড়াশোনা করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার কিম্বা ভাল চাকরি করবে। ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতার বাজারে যেন পণ্য। তাই তাদের কোনদিকে দৃপাত না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজেদের জাহির করার প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। শুধু ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রেই কেন, সামাজিক ক্ষেত্রেও রয়েছে অসম প্রতিযোগিতা। তা না হলে ছেলেমেয়েরাও যেমন বিউটি পার্লারে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় সামিল হচ্ছে, সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই তাদের বাবা-মা, এমনকি দাদু-দিদারাও। আর এই সংকট থেকে মুক্তির পথ হল শুভ চেতনার জাগরণ। প্রতিযোগিতার ইতিবাচক দিককেই গ্রহণ করতে হবে। নিছক প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিযোগিতা নয়, নিজের সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাতে সামিল হতে হবে। অপরের ক্ষতি করে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কোনোমতেই কাম্য নয়।

উপসংহার

প্রতিযোগিতাকে উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ করে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী তাতে সামিল হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিযোগিতার যে কুফল ও সংকট, তা যাতে কোনোক্ষেত্রেই মানুষকে গ্রাস করতে না পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘সর্বম্ অত্যন্তম্ গর্হিতম্’।

Leave a Comment