প্রথাগত শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা

প্রথাগত শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা
প্রথাগত শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা

ভূমিকা

মানুষের মধ্যে পূর্ব থেকে নিহিত যে পূর্ণতা, তার বিকাশ হল শিক্ষা। শিশুর বিকাশে তথা পরিপূর্ণতা সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে একদিকে রয়েছে প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অন্যদিকে রয়েছে বৃত্তিমূলক বা জীবিকামূলক কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা। প্রথাগত শিক্ষালাভ করে একজন ছাত্র বা ছাত্রী আবার সেই প্রথাগত শিক্ষার অঙ্গনেই প্রবেশ করে তাদের ডিগ্রি নিয়ে; অন্যদিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা লাভ করে একজন শিক্ষার্থী সরাসরি কর্মজগতে প্রবেশ করতে পারে। তাই উভয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। 

ইংরেজ শাসনে শিক্ষা

কবি বলেছেন, ‘শুধু পড়াশোনাতে কিছু হয় না। বাজনার বোল লোকে বেশ মুখস্থ বলতে পারে; হাতে আনা বড় শক্ত।’ ইংরেজ শাসক সম্প্রদায় তাদের শাসনতান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে এদেশের সনাতন শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস সাধন করে তার ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষার যে ইমারৎ গড়ে তোলে, তা হল, প্রকৃতপক্ষে কেরাণী গড়ার কারখানা। ইংরেজ শাসনে শিক্ষা ছিল ‘কিঞ্চিৎ পঠনম্, চাকুরিস্য কারণম্’। তাই তা শিক্ষা, সমাজ ও জাতীয় জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। সুতরাং শিক্ষাকে পুঁথির পাতা থেকে জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

প্রথাগত শিক্ষা

ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন হয়েছিল শাসনকার্য পরিচালনার কারণে এবং অন্যদিকে চাকরির কারণে। ডিগ্রি লাভ না করতে পারলে চাকরি জুটবে না, তাই প্রথাগত শিক্ষার প্রসার বাড়ল। বর্তমানে প্রথাগত শিক্ষার অঙ্গনেই শিশুদের প্রথম প্রবেশ ও সেখান থেকেই শুরু হল এই শিক্ষার মধ্যে বদ্ধ হয়ে থাকার অভ্যাস। আমাদের দেশে ও রাজ্যে বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীই প্রথাগত শিক্ষাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। কেনই বা বেছে নেবে না? পাঠ্যসূচি, পাঠ্যপুস্তক, পাঠদান পদ্ধতি সব পুঁথি বা পুস্তক কেন্দ্রিক। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সেই সনাতন কিছু বিষয় গলাধঃকরণ করে ডিগ্রি লাভ করে শিক্ষার্থীরা। প্রথাগত শিক্ষায় তাই শিক্ষা ও ডিগ্রিলাভ সমার্থক হয়ে উঠেছে। হাতে কলমে শেখা বা অর্জিত বিষয়কে প্রয়োগ করার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা প্রথাগত শিক্ষায় না থাকায় শিক্ষার্থীদের বাধ্য হতে হয় শিক্ষার অঙ্গনে থেকে যেতে।

বৃত্তিমূলক শিক্ষা

বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলতে আমরা সেই শিক্ষাপদ্ধতিকেই বুঝে থাকি, যার দ্বারা শিক্ষার্থী বাস্তবজীবন ক্ষেত্রের যে কোনো একটি পেশার ক্ষেত্র সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পেয়ে থাকে এবং শিক্ষার শেষে সে কোনো চাকরির মুখাপেক্ষী না হয়ে থেকে স্বাধীন উদ্যোগেই নিজ জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে পারে। অতীত ভারতবর্ষে গ্রামীণ সমাজে জীবিকা-ই ছিল কুলানুগামী এবং সেক্ষেত্রে ছিল বিভিন্ন কর্মকেন্দ্রিক দিক। তারা পিতা, মাতামহের কাছ থেকে নানা ধরনের হাতের কাজ শিখে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হত। তাঁতীর তাঁত বস্ত্র, ডোমের ঝুড়ি ও বিভিন্ন তৈজস পত্র, কুমোরের হাঁড়ি, কলসি, মৃৎ শিল্পীর ঠাকুর, পুতুল প্রভৃতি দেশে বিদেশে খ্যাতিলাভ করেছিল। আমাদের দেশে পট শিল্পেরও কদর ছিল যথেষ্ট। তাছাড়া জন্মসূত্রে বৃত্তিগত কাজ তাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলত। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে কলকারখানাজাত সামগ্রী আমাদের কুটির শিল্প ও বৃত্তিগত জীবন জীবিকাকে ধ্বংস করে দিল। সেই সূত্রে এল বেকারত্ব। স্বাধীন । ভারতে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি সৃষ্টি হল বৃত্তিমুখী কারিগরি শিক্ষা। ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, ওকালতিতে মানুষ যুক্ত হল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বেকারত্বের কারণে জীবিকাকেন্দ্রিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। পলিটেকনিক কলেজ বিভিন্ন বিষয়কে হাতে নাতে শিখিয়ে জীবিকার পথকে সুগম করল। কৃষিতে নানা শিক্ষণ দিয়ে কৃষির উন্নতিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটল। কুটির শিল্পকে প্রসারের জন্য হাতের কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়া হল। তাঁতের কাজ, ধাতব কাজ, নানা শৌখিন দ্রব্য নির্মাণের কাজ প্রভৃতির ক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার বাড়ল। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ-মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়ায় তা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। বহু শিল্প শিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

উপসংহার

স্বাধীন ভারতে গান্ধীজি বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে কর্মকেন্দ্রিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার আয়োজন করেছিলেন। ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবঙ্গে নীতিগতভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গৃহীত হলেও তা দেশের কিম্বা রাজ্যের ভয়াবহ বেকার সমস্যা নিরসনে যথেষ্ট নয়। তাই দেশ ও জাতিকে স্বনির্ভর করতে হলে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ও তার বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।

Leave a Comment