বর্তমানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সমস্যা রচনা

বর্তমানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সমস্যা রচনা
বর্তমানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সমস্যা রচনা

ভূমিকা

জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি-এ হল মানবজীবনের ক্ষেত্রে সাধারণ সত্য। কেননা ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে/চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে’। জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী রূপে এসেছে জরা ও ব্যাধি। কেননা মানব শরীর ব্যাধি মন্দির। প্রাকৃতিক নিয়মে শৈশব থেকে যৌবন, যৌবন থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ-এ হল বিবর্তনের সূত্র। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে এই বিবর্তন একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান সমাজে স্বাভাবিক নিয়মে হয়ে ওঠা বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা যেন বোঝা-যা মানব সমাজের পক্ষে শোভনীয় নয়।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধা

প্রাচীনকালে মানুষের কাছে ছিল জীবনচর্যার চারটি অধ্যায়-ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। বর্তমান জীবনে এসব অধ্যায়ের কোনো দিকই দেখা যায় না। কিন্তু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যে তাদের প্রিয়জনদের ছেড়ে বাণপ্রস্থে বা সন্ন্যাসে যেতে হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যাঁদের বয়স ষাট-এর ঊর্ধ্বে তাঁরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। তাঁদের নতুন নাম হয়েছে ‘সিনিয়র সিটিজেন’। অর্থাৎ চাকরি থেকে অবসর নিলে তাঁরা বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, কিম্বা সংসার জীবনে ছেলে-বৌ-র হাতে সংসারের ভার অর্পণ করে দিলেই তাঁরা হয়ে গেলেন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। অথবা পূর্বের মতো আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম না করতে পারলে (বয়সোচিত কারণে) তাঁরা হয়ে যান বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা।

পরিবর্তন

সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুরই বদল হয়, বদল হয় রুচি ও চাহিদার, সেইসঙ্গে মানুষের কাছে মানুষের উপযোগও কমতে থাকে-স্বার্থের কারণে। অতীতকালে ভারতীয় তথা বাঙালি জীবনে ছিল একান্নবর্তী পরিবার। সেক্ষেত্রে অন্তত তিন প্রজন্মের মানুষ একই সঙ্গে থাকতো। সেখানে বয়স্কদের সম্মান ছিল, ছোটরাও তাঁদেরকে মান্য করতো। তারপর একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়ে একক পরিবার এল, এল ফ্ল্যাট কালচার তথা ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক ঘরানা। এই ঘরানায় এল দুই থেকে চারজন মানুষের বসবাস। সেখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা স্থান পেল আস্তাকুঁড়ে, তাঁদের ভাগ্যে জুটল অবজ্ঞা, অবহেলা ও বঞ্চনা। যাঁদের সামর্থ্য আছে তারা বৃদ্ধাশ্রম নামক অনাথ আশ্রমের হাতছানিতে সাড়া দিলেন, আর যাঁদের সেই সামর্থ্য নেই তাঁদের স্থান হল রান্নাঘরের এক কোণে, কিম্বা বারান্দার এক চিলতে জায়গায়।

সমস্যার স্বরূপ

বেশ কিছুদিন আগেও পুত্র-কন্যারা তাঁদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাবস্থায় অবসর জীবন কাটাবার জন্য কাশী বা এ ধরনের কোনো ধর্মস্থানে বা তীর্থস্থানে পাঠাতেন। তাঁরাও নিজেদের কর্ম সমাপনান্তে তীর্থক্ষেত্রে গিয়ে ধর্মাচরণে মনোযোগ দিতেন। বর্তমানে সেই তীর্থস্থান হয়ে গেছে বৃদ্ধাশ্রম অথবা ঘরের একচিলতে ছোট্ট জায়গা। আসলে এখন প্রতিটি পরিবারে ব্যক্তিস্বার্থের এমন রমরমা যে স্বার্থের পরিপন্থী যেকোনো বিষয়-ই হয়ে ওঠে কুরুচিকর। ফলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যেহেতু মূল উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই তারা হয়ে ওঠে ‘আস্তাকুঁড়ের এঁটো পাতা’। তাই তাদের মুখ বুজে সহ্য করতে হয়, ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় মেনে নিতে হয় তাঁদের দুর্বিষহ দিনযাপনের গ্লানিকে। তাঁদের কাউকে কাউকে থাকতে হয় অনাথ আশ্রমে। কেউ-বা নিঃসন্তান দম্পতি, অন্য কাউকে বিশ্বাস করে তার দ্বারা খুন হচ্ছেন। আবার যাঁরা অতি বৃদ্ধ-বৃণ (যাঁদের বয়স ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে) তাঁরাও বার্ধক্যের যন্ত্রণায়, বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত হয়ে বিছানায় আয়াদের দ্বারা কোনরকমে জীবন নির্বাহ করছেন। তাঁরা প্রিয়জনের মুখদর্শনও করতে পারছেন না। সেবা-যত্ন তো দূরের কথা। অতি সম্প্রতি কলকাতায় দুই পরিবারে নিঃসঙ্গতা ও একমাত্র সন্তানের মৃত্যু কিম্বা বৃদ্ধ বয়সে সঙ্গী না থাকায় তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এমন ঘটনাও উঠে আসছে।

কারণ

এই সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করলে প্রথমেই যে কথাটি মনে আসে তা হল মূল্যবোধের অভাব। কৃত্রিম স্বার্থসর্বস্ব জীবনে সব কিছুরই মূল্য অর্থের নিরিখে। তাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থা শোচনীয় তো হবেই। দ্বিতীয়ত, প্রজন্মগত ব্যবধান পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করে। তৃতীয়ত, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বয়সোচিত সমস্যা উপলব্ধি করবার মতো মন ও মেজাজ অনেকের থাকে না। চতুর্থত, বেশিরভাগ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অর্থনৈতিক উৎপাদনের সঙ্গে বা চাকুরির পেনশনের সঙ্গে যুক্ত না থাকায় পরিবারে তাঁরা অনর্থ বা আবর্জনা হিসেবেই পরিগণিত হন। পঞ্চমত, আবার যে পরিবারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার একাধিক সন্তান, সেখানেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কারোর কাছেই ঠাঁই পান না। এ যেন ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’-র মতো।

প্রতিকার

এর প্রতিকার করতে না পারলে সমাজ সুস্থ হতে পারবে না। যাঁরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবহেলা করেন, তাঁদের উপলব্ধি করতে হবে তাঁদেরও একদিন এমন অবস্থা হতে পারে। সেদিন যখন আসবে তা হবে ভয়ঙ্কর। কথায় আছে, ‘কাঁদালে কাঁদতে হয়’। সাগর যেমন শুকায় না, পাপও লুকায় না। প্রশ্ন আসতে পারে, এটা পাপ কেন? বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে অর্থ দিলে তো কর্তব্য করাই হয়। উত্তরে বলা যেতে পারে, যে বাবা-মা তিল তিল করে স্নেহযত্নে সন্তানদের মানুষ করেন, তাদেরকে যথাযথ পরিচর্যা ও দেখাশোনা না করে শুধুমাত্র অর্থ দিলেই দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না এবং সে কারণে তা পাপ। আর যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমেও না পাঠিয়ে কোনো এক জায়গায় কোনো রকমে অনাদরে অবজ্ঞায় ফেলে রাখেন, মানসিক অত্যাচার করেন সেইসব মহাপুরুষদের জন্য আদালত সম্প্রতি যেসব নির্দেশ দিচ্ছেন, তাতে তাঁদের লজ্জা পাওয়া উচিত। তাছাড়া যাঁদের ছায়ায়, যাঁদের প্রাণরসে সঞ্জীবিত হয়ে বর্তমান জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলেন, তাঁরা যদি মূলগাছকে ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র ফল খাওয়ার লোভে গাছকেই অবজ্ঞা করেন তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সুখকর হবে না। সে কারণে চাই মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক বন্ধনের দৃঢ়তা, নৈকট্য ও আত্মীয়তা। সম্প্রতি সরকার বয়স্ক নাগরিকদের জন্য ট্রেনে কনসেসন, আসন সংরক্ষণ, জমা টাকায় বেশি সুদ, আয়করে রেহাই প্রভৃতি বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন।

উপসংহার

সুতরাং আজকের নতুন প্রজন্মকে উপলব্ধি করতে হবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সমস্যাকে। সেগুলিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে, মানবিকতার খাতিরে তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সমাজে উপযুক্ত স্থান দিতে পারলে সামাজিক শিষ্টাচার ও সামাজিক বন্ধন যে বজায় থাকবে তা বলাবাহুল্য।

Leave a Comment