![]() |
বাংলার বাউল সংগীত সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। |
বাউলের তাত্ত্বিক পরিচয়
মধ্যযুগে ভণ্ডামি আর বাহ্যিক জাঁকজমকপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মীয় শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদ জানিয়েই বাউল দর্শনের জন্ম। লোকায়ত এই দর্শন মানুষকে এক বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখায়, সেখানে লিঙ্গবৈষম্যও স্থান পায় না। দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীত প্রেমের মাধ্যমে পরমাত্মা বা মনের মানুষকে খোঁজাই বাউল সাধনার মূল মন্ত্র। আর তারই প্রতিফলন ঘটে বাউলের গানে। সহজিয়া বৈয়বদের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য লোকায়ত ধর্মীয় দর্শনের মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া যায় বাংলার বাউল গানে।
বাংলার বাউল গানের বৈচিত্র্য ও পরম্পরা
বাংলা গানের প্রথম লিখিত উৎস চর্যাপদেও দেহতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে পরবর্তীতে বাউল, মুরশিদি, মারফতি বা ফকিরি গানে এই দেহতত্ত্ব ও গুরুসাধনা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাউল গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রূপকের ব্যবহার। এই গানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া নানান উপমা, ব্যঞ্জনা ও রূপক দেহের নানা অংশ এবং সাধনার নানা পর্যায়ের ইঙ্গিত দেয়। বাউল দর্শনের মূলকথা এক হলেও আলাদা আলাদা ঘর বা গুরু অনুযায়ী সাধনার ক্রিয়াকৌশল কিছুটা আলাদা হয়ে থাকে। গোষ্ঠীগুলির গানেও এই ভিন্নতার ছাপ পড়ে।
জাতিধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যক্ষ প্রমাণে বিশ্বাসী বাউলরা প্রকৃত অর্থেই মানবতাবাদী। লালনের গানে তারই পরিচয় মেলে-
“কেউ মালা কেউ তসবী গলে
তাই তো রে জাত ভিন্ন বলে
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কারে?”-
মানবধর্মের উপাসক
এ থেকেই স্পষ্ট, মানবধর্মই হল বাউলের একমাত্র অন্বিষ্ট। সর্ব সংস্কারমুক্ত এক মরমিয়া মনই হল বাউলসাধকের হৃদয়ের স্বরূপ। জাত-ধর্ম-বর্ণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে প্রেমভাবকেই তাঁরা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। এখানে উল্লেখ্য লালন ফকির, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, কাঙাল ফিকিরচাঁদ, হাসান রাজা, আবদুল করিম শাহ, ভবা পাগলার-গানগুলি তাই আজও বাংলার বাউলদের সঙ্গে মানুষের মুখে মুখে ফেরে।