বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অবদান আলোচনা করো

বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অবদান আলোচনা করো
বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অবদান আলোচনা করো।

‘পথের পাঁচালী’ ও ভারতীয় সিনেমার নবজন্ম

সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা সত্যজিৎ রায়ের বাংলা চলচ্চিত্রে প্রবেশ ও সিদ্ধি বাঙালির এক বড়ো পাওনা। তিনি একের-পর-এক কালজয়ী সিনেমা সৃষ্টি করে বাঙালি তথা বিশ্ববাসীর শিল্প রসনা পরিতৃপ্ত করে গেছেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ডি কে গুপ্তর সিগনেট প্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিশুদের জন্য বিভূতিভূষণের ‘আম আঁটির ভেঁপু’-র ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি ‘পথের পাঁচালী’র দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হন। এই পর্বেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিদানন্দ গুপ্ত সহ কয়েকজনের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। ১৯৪৯-এ প্রখ্যাত পরিচালক জঁ রেনোয়া ‘দ্য রিভার’-এর শুটিং-এ কলকাতায় এসে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁকে ‘পথের পাঁচালী’ ছবির জন্য উৎসাহ সত্যজিৎ রায় দেন। এরপর বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি ইউরোপের বিখ্যাত সব সিনেমা দেখার সুযোগ পান। পরে দেশে ফিরে বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের কাজে হাত দেন। নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬-এ আগস্ট ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায়, যা আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ভারতীয় সিনেমাকে চিরকালীন পরিচিতি দেয়। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এই সিনেমা ‘মানবতার শ্রেষ্ঠ দলিল’ শিরোপা পায়।

বিষয়বৈচিত্র্য ও বিশেষত্ব

এরপর একে একে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ ছবি দুটিও চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘অপুর সংসার’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। ‘অপু ট্রিলজি’ করার ফাঁকেই সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন ‘জলসাঘর’, ও ‘পরশ পাথর’-এর মতো উল্লেখযোগ্য ছবি। এরপর প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘দেবী’, রবি ঠাকুরের ছোটোগল্পত্রয় নিয়ে ‘তিনকন্যা’ দারুণভাবে সমাদৃত হয়। এ ছাড়া ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘নায়ক’, ‘অশনি সংকেত’ হল তাঁর অন্যান্য অনবদ্য সৃষ্টি।

কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব

‘ফটিকচাঁদ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ও ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর মতো শিশু-কিশোর মনের উপযোগী সিনেমাও তিনি তৈরি করেছেন। এই ধরনের সিনেমাগুলি শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি হলেও এদের আবেদন চিরকালীন। এ সমস্ত সিনেমা তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। আবার এর পাশাপাশি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সতরঞ্জ কি খিলাড়ী’, ‘সদগতি’ কিংবা ‘গণশত্রু’-র মতো বিভিন্ন বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি সিনেমা তৈরি করে গেছেন। আজ আন্তর্জাতিক সিনেমায় তিনি নিজেই এক স্বতন্ত্র ঘরানার স্রষ্টা। ‘আগন্তুক’ তাঁর শেষ ছবি। তিনি চলচ্চিত্রের জন্য সাম্মানিক ডিলিট, দাদাসাহেব ফালকে, লেজিওঁ দ্য অনার এবং অস্কারের মতো পুরস্কারে পুরস্কৃত। তাই এ কথা বলাই যায়, চলচ্চিত্রে বাঙালির সৃষ্টিশীল, শিল্পিত ও ভাবুক মনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি সত্যজিৎ রায়।

Leave a Comment