![]() |
বিজ্ঞানসাধক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচনা |
ভূমিকা
আচার্য জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম উচ্চারিত হলেও দুজনে পৃথক পৃথক ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক, তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও সেই ইচ্ছার নিয়মে।” কর্মনিষ্ঠ প্রফুল্লচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি যথার্থ।
জীবনী
অধুনা বাংলাদেশের যশোহরে (রাজুলি) ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট প্রফুল্লচন্দ্রের জন্ম। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাশ করে মেট্রোপলিটান ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন। বি. এ. পরীক্ষার আগে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলাত যান। সেখানে প্রথমে বি.এস.সি. পাশ করেন এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি. ডিগ্রি ও বিশ্ববিদ্যালয় হোপ পুরস্কার পান। ১৮৮৮-তে তিনি দেশে ফেরেন। ১৮৮৯-তে রসায়ন বিজ্ঞানে সহকারী অধ্যাপক এবং ১৯১১-তে প্রধান অধ্যাপক হন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ঐ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজের রসায়ন বিভাগে ‘পালিত অধ্যাপক’ হন এবং ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯০১-এ ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড’-এর প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯২৪-৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি যাদবপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রেরণায় ও অর্থসাহায্যে ‘ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আবিষ্কার
একসময় আচার্য নিজেই বলেছিলেন, ‘আই বিকেম আ কেমিস্ট বাই মিসটেক’। নিজেকে ঠাট্টা নয়, তাঁর সারাজীবনের স্বরূপ উপলব্ধি করলে বোঝা যায়, তিনি হয়তো মিথ্যে বলেন নি। সে যাই হোক, তাঁর বয়স যখন চৌত্রিশ তখন তিনি তাঁর বিজ্ঞান আবিষ্কারের জন্য খ্যাত হন। তাঁর লক্ষ্য ছিল মৌল আবিষ্কার করে রসায়নের জগতে অমর হওয়া। রসায়ন জগতে, দুটো অস্থায়ী জিনিস একত্রিত হয়ে যে একটা স্থায়ী যৌগ তৈরি হতে পারে এমন বিশ্বাস গবেষকদের মধ্যে ছিল না। প্রফুল্ল রায় প্রমাণ করলেন, পারদের সঙ্গে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় কীভাবে মারকিউরাস নাইট্রাইট তৈরি হতে পারে। তবে তিনি নাইট্রাইট আবিষ্কারে ব্যর্থ হলেও সোনা ও প্লাটিনাম গোত্রের বিশেষ বিশেষ যৌগ প্রস্তুতে তাঁর সাফল্য আধুনিক রসায়নে গুরুত্বপূর্ণ। ওই পদার্থটি ছাড়া আরও যেসব শ্রেণির যৌগ তৈরির লক্ষ্যে প্রফুল্লচন্দ্র সফল হন, সেগুলি হল অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট, সালফার-ঘটিত জৈব পদার্থ এবং প্লাটিনাম, ইরিডিয়াম কিংবা সোনা সংবলিত জৈব রাসায়নিক। নতুন পদার্থের সংশ্লেষণ ছাড়া ঘি, মাখন, তেলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়েও গবেষণা করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র-যার উদ্দেশ্য ছিল ওসবে ভেজাল ধরা।
অন্যান্য কাজ
তিনি ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বিজ্ঞানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি সাধন করা তথা পরাধীন ভারতীয়দের আত্মমর্যাদাকে বাড়ানো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্পোন্নতি বিধানের এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের প্রচেষ্টায় তাঁর অদম্য উৎসাহ ছিল। চিরকুমার প্রফুল্লচন্দ্র অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন। ছাত্র-শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় প্রীতির বন্ধন ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর সহানুভূতি। সব ধরনের জাতীয় শিক্ষা শিল্পোদ্যোগের প্রতি অকৃপণ সহায়তা ও মানবকল্যাণে অর্জিত অর্থের অকাতর বিতরণ তাঁকে দেশবাসীর সামনে বিশিষ্ট করে তুলেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শিক্ষার উন্নতিকল্পে তিনি প্রায় দু লক্ষ টাকা দান করেন। দরিদ্র ছাত্রদের অর্থসাহায্যও তিনি করতেন। জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতি হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন তিনি। ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তিনি অকাতরে দান করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
তাঁর রচিত আত্মচরিত ‘Life and experiences of a Bengali Chemist’ (১৯৩২) এবং ইংরেজি বাংলায় রচিত বহু ধরনের প্রবন্ধাবলী তাঁর সাহিত্য সাধনার পরিচয় বহন করে। তাঁর ‘আত্মচরিত’ ইংরেজিতে রচিত হলেও বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। গ্রন্থের মুখবন্ধে প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছেন, “শুধু নিজের জীবনী নয়, প্রায় অর্ধশতাব্দী ব্যাপী অভিজ্ঞতামূলক সমসাময়িক অর্থনীতি, শিক্ষাপদ্ধতি ও তাহার সংস্কার, সমাজসংস্কার প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ক সমালোচনা এই পুস্তকের বিষয়বস্তু।” ‘আত্মচরিত’ এক অর্থে বাঙালির জীবন দর্পণ। এছাড়া বাংলায় রচিত ‘বাঙালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’ এবং ‘অন্নসমস্যায় বাঙ্গালীর পরাজয় ও তাহার প্রতিকার’ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘History of Hindu Chemistry’ দু খণ্ড (১৯০২, ১৯০৯) প্রকাশিত হয়। চরক, সুশ্রুত, ভগভট্ট, বৃন্দ, চক্রপাণি কিংবা নাগার্জুন যে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে গেছেন, সেইসব অজানা দিকগুলিকে এই দুখণ্ডে প্রকাশ করেছেন- যা তাঁর দীর্ঘ গবেষণাসমৃদ্ধ রচনা।
পুরস্কার
১৯২১-এ গান্ধীজির খদ্দর প্রচারে তিনি অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের সি. আই. ই. ও নাইট উপাধি ছাড়া দেশি, বিদেশি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রি তিনি পান। অন্যদিকে লন্ডন ও মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত সদস্যরূপে গ্রহণ করে। ১৯১০ খ্রি. রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান সভার তিনি মূল সভাপতি ছিলেন।
উপসংহার
পরাধীন ভারতে যেখানে বাঙালি তথা ভারতবাসীর মেধাকে ইংরেজরা নিজেদের থেকে নিম্নমানের বলে মনে করত, সেই সময়ে প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর মেধা ও গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ভারতবাসীরাও পিছিয়ে থাকার নয়। শুধু তাই নয়, রসায়ন শিক্ষার প্রসারে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা স্মরণীয়। আজীবন তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন, তাই তাঁর কর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে শুধু তাঁর গবেষণা নয়, দেশের ও জাতির প্রতি তাঁর যে ত্যাগ সে কথা স্মরণ করে, তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়াই হবে আমাদের প্রধান কাজ।