বিজ্ঞাপন ও বর্তমান সংস্কৃতি রচনা

বিজ্ঞাপন ও বর্তমান সংস্কৃতি রচনা
বিজ্ঞাপন ও বর্তমান সংস্কৃতি রচনা

ভূমিকা

বিশ্বায়নের ফলে বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। তাই বর্তমান যুগ বিজ্ঞাপনের যুগ, প্রচারের যুগ। এ যুগের মানুষের মানসিকতা ‘নিজের ঢাক নিজে পেটানো’র। সেজন্য সর্বক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপন তাঁর মৌরসী পাট্টা বিস্তার করেছে অবলীলাক্রমে। দূরদর্শনে, বেতারে, খবরের কাগজে, ট্রামে-বাসে সর্বত্র বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। বিজ্ঞাপন দেখে আজকের মানুষ তার পছন্দসই জিনিস ক্রয় করছে, বিজ্ঞাপন শুনে ব্যক্তিটি তার মানানসই দ্রব্যটি পছন্দ করছে, খবরের কাগজে পাত্র-পাত্রী ও চাকরির বিজ্ঞাপন পড়ে যে যার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছে; বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দূর হয়ে যাচ্ছে নিকট। বলাবাহুল্য-বিজ্ঞাপন আমাদের সংস্কৃতির হালচালকে পাল্টে দিচ্ছে। আর এই বিজ্ঞাপনের সুবিধাও যেমন মানুষ ভোগ করছে, তেমনি বিজ্ঞাপন মানুষকে প্রতারিতও করছে। সব মিলিয়ে বিজ্ঞাপন আধুনিক যুগে জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। 

অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে বিজ্ঞাপন

অনেকের মতে বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবসায়ীরা যে বাড়তি খরচ করেন, সেই খরচ তাকেই বহন করতে হয়। তাই বিজ্ঞাপন পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাহায্য করে-এই অভিমত অনেকের। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ্রা মনে করেন-বিজ্ঞাপন দিলে জিনিসের দাম বাড়ে, এ ধারণা ঠিক নয়। এঁদের মতে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের প্রচার বাড়ে এবং তার ফলে চাহিদা বাড়ে। চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর যে পণ্যের উৎপাদন যত বেশি সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতার লাভও বেশি হয়। যেমন ৬৪ পৃষ্ঠার একটি বই পঞ্চাশ কপি ছাপালে যে খরচ পড়ে, পাঁচ হাজার কপি ছাপা হলে তার আনুপাতিক ব্যয় হয় অনেক কম। অর্থনীতিবিদদের এই যুক্তি অর্থাৎ প্রচার বাড়লে পণ্যের উৎপাদন বাড়ে এবং ফলে তার দাম কমে। এই যুক্তি আমেরিকার মতো উন্ন দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে সম্পূ। গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপনের বাহার যত চমকপ্রদ তার দামবৃদ্ধিও আশ্চর্যজনক।

বিজ্ঞাপন ও চারুকলা

সুন্দর ছবি, শ্রুতিমধুর গান, উৎকৃষ্ট লেখা সকলকেই আকৃষ্ট করে। তাই চাবুকলার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের যোগ। বিজ্ঞাপনদাতারা মানুষের এই ভালোলাগাকে বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করেন মানুষকে আকৃষ্ট করবার জন্য। শিল্পকলা-সম্মত বিজ্ঞাপন দিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেন। কোনো একটি বিখ্যাত বস্ত্র প্রতিষ্ঠানে একটি সুন্দরী মেয়ের নৃত্যরত মডেলে বেনারসী শাড়ি পরানো আছে, তা কোনো একজন রুচিসম্পন্ন মহিলাকে আকৃষ্ট করতেই পারে। অথবা কোনো ‘বিল্ডার্স’-এর ক্যালেন্ডারে সুন্দর বাগান ও পারিপার্শ্বিক পটভূমি সহ বাড়ির ছবি যারা বাড়ি করতে চায়, তাদেরকে আকৃষ্ট করে।

বিজ্ঞাপনের ভাষায় সাহিত্যের প্রভাব

বিজ্ঞাপনের ভাষায় সাহিত্যের প্রভাব অপরিসীম। বিজ্ঞাপনের ভাষা সহজ, সরল ও সাধারণের বোধগম্য হওয়া উচিত। যেমন ‘থাক লক্ষ্মী, যাক্ বালাই’ কিংবা ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনে ব্রতকথা স্থান পেয়েছে-‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি সব ঘরে ঘরে/রাখিবে তন্ডুল তাহে এক মুষ্টি করে/সঞ্চয়ের পন্থা ইহা জানিবে সকলে/ অসময়ে উপকার পাবে এর ফলে’। অথবা ‘পাঞ্জাবী পাজামা চুড়িদার/কিম্বদন্তী সবাকার’ ইত্যাদি। তবে বিজ্ঞাপনের ভাষা কিছু কিছু দুর্বোধ্য-সর্বত্র একইরকম শ্রুতিসুখকর হয় না, আবার যত্রতত্র সাধু এবং চলিতের সংমিশ্রণও ঘটে থাকে।

আধুনিক বিজ্ঞাপনে অসাধুতা

আধুনিক বিজ্ঞাপনে অগ্রিম পাঠান। এরপর টাকা পাঠাবার পর তার কাছে আসে অসাধুতা বর্তমানে শুধু রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন নয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে অসাধুতা। তাই বিজ্ঞাপনও তার ব্যতিক্রম নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপনে নানারকম চালাকির আশ্রয় নেয়। মাত্র চল্লিশ টাকায় রেডিও কিনুন, অমুক ঠিকানায় খেলনা রেডিও। সম্প্রতি বিজ্ঞাপনে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ছবি ভেসে আসে যার দ্বারা অপরিণতবুদ্ধি ক্রেতাদের মন ভোলাবার চেষ্টা করা হয়। যৌন আবেদনপূর্ণ বিজ্ঞাপন অনেক সময় নোংরামির পর্যায়ে নেমে যায়। এতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষতি হয় বেশি। এখন আবার প্রতিটি বস্তুর সঙ্গে অন্য কিছু ‘ফ্রি’ দেবার কৌশল বিজ্ঞাপনে প্রচারিত হচ্ছে এবং সেই আকর্ষণে ক্রেতারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুও কিনে ফেলছে।

বিজ্ঞাপন ও আধুনিক সংস্কৃতি

বিজ্ঞাপন এখন ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। তাই তার ভালো ও মন্দ দুই দিকই প্রভাব ফেলেছে জনজীবনে। সংস্কৃতি হল সভ্যতা তরুর পুষ্প। আজ এই সংস্কৃতির অঙ্গনে বিজ্ঞাপনের রমরমা। ভারতের মতো বিশাল লোভনীয় বাজারের কথা ভেবে বহুজাতিক সংস্থাগুলি যেভাবে প্রতিযোগিতায় নেমেছে তাতে দীর্ঘদিনের ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিলুপ্ত হতে চলেছে-যা আধুনিক সংস্কৃতি বাঞ্ছনীয় নয়। বিজ্ঞাপন হল ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে একটি মাধ্যম। এই মাধ্যম যদি সুস্থ হয় তাহলে তা সকলের ক্ষেত্রেই মঙ্গল।

উপসংহার

বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিজ্ঞাপনের কোনো বিকল্প নেই একথা যেমন সত্য, তেমনি বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়িও বড্ড বিসদৃশ। কারণ যেখানে ভারতবর্ষে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে, যাদের ২ টাকা কেজি দরে রেশনে চাল, গম দিতে হয় সেখানে বিজ্ঞাপনের মন্দ দিকটির কথা ভাবতেই হয়।

Leave a Comment