![]() |
বিশ্ব উষ্ণায়ন : সমস্যা ও প্রতিকার রচনা |
ভূমিকা
শুধু পরিবেশের দিক থেকে নয়, পৃথিবীর সার্বিক অগ্রগতিতে বিশ্ব উষ্ণায়ন এক জ্বলন্ত সমস্যা। মনে রাখতে হবে যে পৃথিবী মানুষের বসতির একমাত্র স্থান, তা আজ বিপন্ন। পৃথিবীর বিপন্নতাজনিত পরিবেশের যে সংকট বর্তমানে সবচেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে, সেই সংকটের নাম গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি। এর জন্য দায়ী মানুষের অতিরিক্ত ভোগাকাঙ্ক্ষা এবং গ্রিন হাউস এফেক্ট। রাষ্ট্রসংঘ এই বিপদকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যার সমাধানে তৎপর হয়েছে। সেজন্য ২০০৭-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক শহরে ১২০টি দেশের চারশত প্রতিনিধি মিলিত হয়ে ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করেছেন।
আশঙ্কা
আশঙ্কাসারা পৃথিবী জুড়ে উষ্ণাতার ক্রমবর্ধমান অবস্থাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ (Global Warming)। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গড়ে তাপ বেড়েছে ০-৫° সে.। আবার ১৯০০ থেকে ২০০০ সনের মধ্যে ১° সে.। ১৯৯২ সালে UNEP গঠিত Inter-Governmental Panel of Climate Change (IPCC) হুঁশিয়ারী দিয়েছেন যে, যে মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে তা যদি কমানো না হয় তাহলে ২০৪০ সালে আবহাওয়ার তাপমাত্রা বর্তমান তাপমাত্রার চাইতে ১° সেন্টিগ্রেড বাড়বে। মেরু অঞ্চলে এই বৃদ্ধি সর্বাধিক হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলে যাবে, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস দেখা দেবে, মাটি শুকিয়ে যাবে, ব্যাপক দাবানলে বনাঞ্চল ধ্বংস হবে এবং পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণের বিরাট হেরফের ঘটবে। ক্ষতিকারক পতঙ্গের প্রজনন ক্ষমতা হঠাৎ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে শস্য উৎপাদন কমে যাবে। গৃহপালিত জীবজন্তুর অসুস্থতা বাড়বে। কিছু শস্য ধ্বংসকারী ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া উন্ন ও আর্দ্র অবস্থায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে এবং তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে দেশীয় অর্থনীতির উপর। খরা মারাত্মক আকার নেবে, মরু অঞ্চলের আয়তন বাড়বে। এলনিনোর মতো আবহ বিধ্বংসী ঝঞ্ঝার মাত্রা ও সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাপদাহজনিত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হৃদ্যন্ত্রসংক্রান্ত অসুখে মৃত্যুর হার বাড়বে। তাছাড়া হিমবাহ থেকে বরফ গলে নেমে আসবে; অনেক দেশ, শহর জলের নীচে চলে যাবে, সমুদ্রের জীবকুলের মৃত্যু ঘটবে এবং খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের অপরিমিত ভোগের চাহিদা, প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং সর্বোপরি বিশ্বায়ন মানব সভ্যতাকে যেমন ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছে, তেমনি পৃথিবীর উষ্ণীকরণের সমস্যা তীব্রতর হয়েছে। বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, মিথেন, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন ইত্যাদি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বিকীর্ণ অবলোহিত রশ্মির কিছুটা অংশ ভূ-পৃষ্ঠে বিকিরণ করে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় ও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই ঘটনাকে গ্রিন হাউস এফেক্ট বলা হয়ে থাকে। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের আগে উত্তর গোলার্ধের বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড-এর গাঢ়ত্ব ছিল ২৮০ PPM (Parts Per Million) এবং বর্তমানে তার মান ৩৫৬ PPM। এই মাত্রা প্রতি বছরই বাড়ছে। এই বাড়ার কারণ হল: (ক) জীবাশ্ম জ্বালানির দহনের ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি। (খ) জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারে CO, বৃদ্ধি। (গ) পচা জৈব আবর্জনা, গবাদি পশুর গোবর, ধান খেত থেকে নিঃসৃত গ্যাস থেকে মিথেন বৃদ্ধি। (ঘ) রং শিল্প, ইলেকট্রনিক শিল্প, রেফ্রিজারেশন প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বৃদ্ধি। (ঙ) নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহার, বন কাটা প্রভৃতির জন্য নাইট্রাস অক্সাইড বৃদ্ধি প্রভৃতি। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান ২১%, সি. আই. এস.-এর অবদান ১৪%, ফ্রান্স-জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপের শিল্পসমৃদ্ধ দেশের অবদান ১৪% এবং ভারতের অবদান ৪%।
উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলাফল
পৃথিবীর এই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলাফল বেশ ভয়ংকর। কারণ, (ক) আগামী ৫০ বছরে গড় দৈনিক তাপমাত্রা ২০ থেকে ৫° সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে। (খ) বাস্তুতন্ত্র ও সমস্ত জীবজগতের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। (গ) হিমবাহ এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর স্থলভাগের বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উত্তোলন ঘটবে। (ঘ) অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে-প্রায় ৪৪% স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হবে। অনেক পাখি ও কীটপতঙ্গের প্রজাতি অবলুপ্ত হবে। (ঙ) উপকূলের নীচু জমি প্লাবিত হওয়ার ফলে ঐ এলাকার কৃষিজমি, জনবসতি, বন্দর প্রভৃতির ক্ষতি হবে। মুম্বাই, কলম্বো, টোকিও প্রভৃতি সমুদ্রের ধারে গড়ে ওঠা বড়ো শহর ও বন্দরগুলি তলিয়ে যাবে। (চ) কিছু গবেষকের হিসাব, তিব্বতের কিংখাই মালভূমির আকাশে প্রায় ২৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ওজোন গ্যাসের স্তর পাতলা হয়ে গেছে। এর ফলে তিব্বতের আকাশে ওজোনের ঘনত্ব কমে দাঁড়িয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম। যার ফলে মানস সরোবর ভ্রমণেচ্ছুদের সাবধান হতে হবে।
্প্রতিকার
রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আই. পি. সি. সি.)-এর ব্যাঙ্কক বৈঠকে ওয়ার্কিং গ্রুপের সহ-সভাপতি ডেভিডসন জানিয়েছেন, “এখন যা চলছে, তা চললে পৃথিবীর বিপদ সাঙ্ঘাতিক। তাই সমস্যা সমাধানের পথ বাতলানোর কথা ভাবা হয়েছে।” সেই পথ সম্বন্ধে ঐ সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে শিল্পায়নের আগে পৃথিবীর উদ্ভুতা যা ছিল, তার জেরে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি আটকাতে গেলে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ ০.০৪৪৫ শতাংশ মাত্রায় আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বেশি করে জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। তেল ও কয়লার ব্যবহার কমিয়ে অচিরাচরিত শক্তির উৎসকে ব্যবহারে লাগানো। গ্রিন হাউস গ্যাস বিশেষ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস হিসেবে পরমাণু শক্তির ব্যবহার করতে হবে। উন্নত দেশগুলি যেভাবে সি. এফ. সি. নির্গমন করে চলেছে এবং যার ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরে যে সব ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে সে সম্বন্ধে দেশগুলির এখনই সাবধান হতে হবে।
উপসংহার
বিশ্বায়নের পর বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে তেল ও অস্ত্রের যে গুরুত্ব বেড়েছে, সেক্ষেত্রে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি নতুন মোড় নিয়েছে। উষ্ণায়নের নামে এই যে পরিবেশের সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের আত্মঘাতী রূপ-কে প্রকট করে তুলেছে। নিন্দুকেরা বলতে শুরু করেছে, উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নকে থমকে দিতে এ ধরনের প্রচার চলছে। কিম্বা উন্নত দেশগুলি এই সংকটের কথা না ভেবে শুধু মুনাফার বৃদ্ধিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এই উভয় দিকই গ্রহণীয় নয়। বরং সময় থাকতে সমস্যার সমাধানে তৎপর হওয়া যে বুদ্ধিমানের কাজ-সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, নতুবা পৃথিবীর বিপন্নতার জন্য আমরা দায়ী থাকব।