![]() |
বিশ্ব যোগ দিবস রচনা |
ভূমিকা
‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো’-এই যোগ বিশ্বের মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক যোগ-যা ভারতবর্ষের বহুকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে গত ২১শে জুন ২০১৫ প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ভারতের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যোগ দিবস পালন করে জনমানসে সাড়া ফেলে দিয়েছে। আবার এই যোগ দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বায়ন-উত্তরকালে বাজার অর্থনীতিও সজীব হয়ে উঠতে পেরেছে।
উদযাপন
দিল্লির রাজপথে (২১শে জুন, ২০১৫) প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ যোগাভ্যাস করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এবং এবছরও একইভাবে যোগ দিবস পালিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উৎসাহিত যোগাভ্যাসকারীদের জানালেন, ‘যোগ হচ্ছে একটা যাত্রা, আমি থেকে আমরায়, আমি থেকে বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার যাত্রা। এটা একটা মানসিক অবস্থান।’ শুধু জানালেন না, নিজেও যোগ করলেন সকলের সঙ্গে। কলকাতাতে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামেও পালিত হয় যোগ দিবস। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও উৎসাহের সঙ্গে তা পালিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন, আদ্যাপীঠ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মহারাজরাও এই যোগ দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
স্বরূপ
ভারতে দিল্লির অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ৮৪টি দেশের মানুষ। এক জায়গায় সবচেয়ে বেশি ৩৫৯৮৫ জন মানুষ একত্রে যোগাভ্যাস করে গিনেস বুক রেকর্ড করে ফেলেন। ভারত ছাড়াও ১৯০টি দেশে এদিন পালিত হয়েছে প্রথম আন্তর্জাতিক যোগ দিবস। অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, চিন, আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালিত হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জে যোগ উদ্যাপনে পৌরোহিত্য করেন যোগগুরু রবিশঙ্কর। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুনও স্বীকার করে নেন, ‘যোগ ভেদাভেদ করে না। কারণ, যে কোনও বয়স ও সামর্থ্যের মানুষই যোগাসন অভ্যাস করতে পারেন।’ ভারতের আশা যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগসম্বন্ধও স্থাপিত হতে পারে।
যোগ কী?
পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ যে শ্রেষ্ঠ যোগী ছিলেন এবং যোগের বিষয়টি যে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে পরম্পরায় ভারতবর্ষে চলে আসছে তা সর্বজনস্বীকৃত। গীতায় যোগ সম্বন্ধে নানা কথা বলা হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দও এ বিষয়ে তাঁর ‘রাজযোগ’ গ্রন্থে বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। সবরকম যোগেরই উদ্দেশ্য হল পাঁচরকম ক্লেশ বা কষ্ট বা দুঃখদায়ী চিত্তের দোষ দূর করা। এগুলি হল-রাগ, বিদ্বেষ, অবিদ্যা, অভিনিবেশ, অস্মিতা। যোগ আর কিছুই নয়-যার দ্বারা আচরণে ও অনুভবে সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে। সব শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, রুচি, মত, পথ-সর্বত্র সমদৃষ্টি অভ্যাস করা হচ্ছে যোগের সব থেকে বড় কথা।
যোগের বিভাগ/ গুণাবলী
যোগ আট রকমের: (ক) যম (খ) নিয়ম (গ) আসন (ঘ) প্রাণায়াম (ঙ) প্রত্যাহার (চ) ধারণা (ছ) ধ্যান (জ) সমাধি। যম হল সংযম। এই সংযম পাঁচ ধরনের-অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (কথায়, আচরণে বা ভাবের ঘরে চুরি না করা), ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ (না-খেটে রোজগার না করা, দান বা উদ্বৃত্ত মুনাফা গ্রহণ না করা)। অন্যদিকে নিয়ম হল-শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর প্রণিধান। এরপর প্রয়োজন আসন ও প্রাণায়াম। কিন্তু সংযম ও নিয়ম পালন না করে আসন ও প্রাণায়াম করা যোগের বৈধ রীতি নয়।
যোগ-এর বিভিন্ন রকম অর্থ করেছেন শ্রীশ্রী সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ তাঁর ভগবদ্গীতার ‘প্রণব-প্রেম-পীযূষ’ ভাষ্যে,-যোগ হয় তখন যখন-
(১) এক বস্তুর সঙ্গে বাহ্যবস্তু সংলগ্ন হবে। (২) এক বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর মিশ্রণ ঘটে। (৩) কার্যকারণসমূহের একত্রীকরণ। (৪) যোদ্ধাদের অস্ত্রাদি বিশেষ রূপে ধারণ। (৫) বস্তুতত্ত্ব নিশ্চায়ক যুক্তিবাক্য। (৬) প্রকৃত তত্ত্ব গোপনপূর্বক কার্যপ্রদর্শন। (৭) দেহকে দৃঢ় ও সুস্থিরকরণ। (৮) শব্দ বিন্যাসের সুশৃঙ্খলা। (৯) শব্দের অর্থবোধিকা শক্তি বিশেষ। (১০) কৌশলে কার্য সমাধা করা। (১১) লব্ধ বস্তু রক্ষণাবেক্ষণ। (১২) চিন্তার দ্বারা দুর্লভ্য উপায় পরিজ্ঞান। (১৩) বস্তুকে অন্য এক নূতন আকারে পরিণত করা। (১৪) আত্মায় আত্মায় সংযোগসাধন। (১৫) বস্তুবিষয়ক চিন্তাপ্রবাহ উত্থাপিত করা। (১৬) সমস্ত মনোবৃত্তি নিরোধ। (১৭) চিত্তকে একাগ্রকরণ প্রভৃতি যোগের অপর নাম।
বাজার অর্থনীতি ও যোগ
গ্লোবালাইজেশনের যুগে ভারতের যোগগুরুদের বাজার তৈরি করে দেবার অভিযোগও উঠেছে এই যোগ দিবসকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ উঠেছে বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদের মাধ্যম হিসেবে একে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। কেননা যে স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বসভায় ভারতকে একদিন যোগ করতে পেরেছিলেন তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘ধ্যান করবে মনে, বনে, বাজার অর্থনীতি ও কোণে।’ কিম্বা ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে, ‘বিবিক্তদেশসেবিত্বম্’, ‘অরতির্জন সংসদি’-ভিড় অপছন্দ করা, নির্জন স্থানে থাকবার প্রবণতা। তাহলে যোগকে রাজপথের রাস্তায় নামিয়ে আনা ক রাজনীতির ফায়দা তোলার জন্যে। এ যোগ না জোক্ (Joke)-এই প্রশ্নও উঠেছে। (অরিন্দ চক্রবর্তী-‘এই সময়’ ২২শে জুন, ২০১৫)। কেননা, এখনকার যোগবিক্রেতা গুরুরাই ভার। সরকারের বৈদিক বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা রপ্তানির মার্কেটিং ম্যানেজার।
উপসংহার
আসলে বাজার অর্থনীতিতে সবকিছুরই মূল্যমান নির্ধারিত হয় বাজার (Market)-কে কেন্দ্র করে। যোগও সেই বাজার-ভিত্তিক তা বলাবাহুল্য। সত্যিই তো যোগ ঠাট্টার ব্যাপার নয়, যোগ হল জীবনকে সুষ্ঠুভাবে অতিবাহিত করবার এক নীতিনিষ্ঠ প্রণালী। এর জন্য চাই সংযম ও নিয়মনিষ্ঠ হওয়া। কিন্তু এই ভোগবাদী জীবনে যেখানে চারদিকে মিথ্যার বেসাতি, ছলনার যাদুখেলা, লোক দেখানোর হুড়োহুড়ি সেখানে যোগ তো বুমেরাং হয়ে আসতে পারে। কারণ আগে তো ভোগাকাঙ্ক্ষাকে সংযম ও নিয়মের মধ্যে বাঁধা, নিজেকে সত্যনিষ্ঠ করা তারপর তো আসন ও প্রাণায়াম। নতুবা ভোগের মাঝখানে যোগ কিম্বা ভোগসর্বস্বতার মধ্যে লোক দেখানো যোগ তো বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। সুতরাং যোগ যদি আমাদের ভোগসর্বস্ব আকাঙ্ক্ষাকে, হিংসা-বিদ্বেষকে, অস্মিতা-অবিদ্যাকে দূর করে যথার্থ মানুষ করে তুলতে সাহায্য করে তাহলে সেই যোগ ও যোগ দিবস পালনকে স্বাগত জানাতে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।