ভারতের আদিবাসী ও জঙ্গলের অধিকার রচনা

ভারতের আদিবাসী ও জঙ্গলের অধিকার রচনা
ভারতের আদিবাসী ও জঙ্গলের অধিকার রচনা

ভূমিকা

ভারতবর্ষের আদিবাসীদের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ভারতবর্ষ পুলিন্দ, শবর, ব্যাধ প্রভৃতিদের নিকট হইতেও বীভৎস সামগ্রী গ্রহণ করিয়া তাহার মধ্যে নিজের ভাব বিস্তার ভূমিকা করিয়াছে, তাহার মধ্য দিয়াও নিজের আধ্যাত্মিকতাকে অভিব্যক্ত করিয়াছে।” ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা হল আদিবাসীরা-যাদের প্রোটো অস্ট্রালয়েড বা অস্ট্রিক বলা হয়ে থাকে। এদেশের সাঁওতাল, কোল, ভীল, মুন্ডা, শবর, খেড়িয়া, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায় আদিবাসী নামে পরিচিত এবং তারাই জঙ্গলে ঝুম চাষের মাধ্যমে জঙ্গলের আদিবাসীরূপে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছে। সরকার আদিবাসীদের উন্নয়নে নানান কর্মসূচি নিয়েছে।

আদিবাসীর পরিচয়

আদিবাসী বা Tribe বলতে সেই মানুষদের বোঝান হয় যাদের পূর্বপুরুষ এই ভারতবর্ষে আদিম বাসিন্দা। এদের গায়ের রঙ কালো বলে ভারতবর্ষকে একসময় কৃষ্ণ ভারতবর্ষ বলা হত। এদেরকে নেগ্রিটো বলা হত। কেরলের কানিক্কর, পানিয়ান, মুথিওয়ান, উড়ালি প্রভৃতিরা নেগ্রিটো। অন্যদিকে সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভিল, শবর, চেনচু, হোস প্রভৃতি আদিবাসীদের প্রোটো অস্ট্রালয়েড বলা হত। খাসি, গারো, ডাফলা, লালুং, চাকমা, কাছারি, কুফি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীরা মোঙ্গলীয় গোষ্ঠীর। ভৌগোলিক বণ্টন অনুসারে আদিবাসীদের তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। (ক) উত্তর ও উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যসমূহ। (খ) মধ্যভারতের বিভিন্ন এলাকা, (গ) দক্ষিণ ভারতের রাজ্যসমূহ। সাঁওতালদের বাস হল মূলত পশ্চিমবঙ্গে বিরহোড়, গন্দ, মুন্ডা, ওঁরাওদের বাস বিহারে; অবর, নাগা, খাসি প্রভৃতিদের বাস হল আসামে খন্দদের বাস হল ওড়িশাতে, কেরালা, মধ্যপ্রদেশে; লেপচারা সিকিমে, মুড়িয়ারা ছত্রিশগড়ে, চেনচু-রা অন্ধ্রপ্রদেশে, কুকি-রা মণিপুরে, মিনা-রা রাজস্থানে, টোডা-রা তামিলনাডুতে বাস করে। পশ্চিমবঙ্গে স্বীকৃত আদিবাসী গোষ্ঠী প্রায় চল্লিশটি এবং মোট জনসংখ্যার নিরিখে আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসীদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়-শক্তিশালী ও বৃহৎ গোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠী। সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাঁও, হো, কুড়মী গোষ্ঠীর আদিবাসীরা শক্তিশালী গোষ্ঠীর। দুর্বল গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বিরহোড়, লোধা, খেড়িয়া, শবর, অসুর, পাহাড়িয়া প্রভৃতি। আদিবাসীদের মধ্যে বিভেদও যথেষ্ট। তাই সাঁওতাল গোষ্ঠী লোধা বা খেড়িয়াদের অবজ্ঞা করে। দুর্বল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা বরাবরই শক্তিশালী আদিবাসী গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী। 

বঞ্চনা

আদিবাসীরা মূলত জঙ্গলবাসী। জঙ্গল-ই তাদের জীবিকার মাধ্যম। একসময় আদিবাসীরা তাদের প্রয়োজনে বন কেটে ঝুম চাষের মাধ্যমে জঙ্গলে বসবাস শুরু করেছিল। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘বীরসা মুন্ডা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ছোটনাগপুরের অন্তর্গত সিংভূম, রাঁচি, পালামৌ এসব জেলায় মুন্ডা, ওরাঁও, হো আদিবাসীদের বসতি ছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থাৎ ১৭৫০-১৮০০ সালের সময়ে এখানে বাইরের জমিলোভী মানুষজন ঢুকে পড়ে। এর ফলে আদিবাসীদের চাষবাস ও গ্রাম সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে লাগল। জঙ্গল হাসিল করে তারা যে খুটকাট্টি গ্রাম পত্তন করেছিল, তা আর তাদের রইল না। ছোটনাগপুরের রাজা তার আত্মীয়স্বজনকে জমি ও গ্রাম দিয়ে জায়গিরদার করে দিল যখন, তখন মুণ্ডারা সরে যায় দক্ষিণে ঘুঁটি ও পশ্চিমে তামাড় অঞ্চলের পাহাড়ি জঙ্গল এলাকায়। ১৮৩১-৩২ সালের কোল বিদ্রোহের পর সে সব জায়গাতেও জমিদার ও জায়গিরদাররা চলে এল। এরা রাজা আর আদালতের কাছে দখলের কাগজ বা পাট্টা নিয়ে মুন্ডা গ্রামগুলি অধিকার করতে থাকল। ১৮৬৩ সাল অবধি ইংরেজ সরকার জমিদারদের পুলিশের কাজ করার ক্ষমতাও দিয়ে রেখেছিল। ফলে মুণ্ডারা হারাল স্বাধীনতা। ভেঙে পড়ল তাদের গ্রাম ও সমাজ ব্যবস্থা। জমির দখল তাদের চলে গেল। পহান ও মানকির কোনো ক্ষমতা রইল না। জমিদাররা তাদের কাছ থেকে খাজনা হিসেবে ফসল তো নিলই আবার জোর করে বিনা মজুরিতে বা বেঠবেগারিতে খাটিয়ে নিতে থাকল। এইসব বাইরের অত্যাচারী লোকরাই মুণ্ডা-সাঁওতাল-হো-ওরাঁওদের কাছে দিকু নামে পরিচিত।” মহাশ্বেতা দেবীর এই বিবরণ প্রমাণ করে আদিবাসীরা জঙ্গলের আদি বাসিন্দা হয়েও তারা জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। 

অধিকার অর্জনে বিদ্রোহ

জঙ্গলের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের অধিকার সাব্যস্ত করতে নানান ধরনের আন্দোলন করেছে। ১৮৯৯-১৯০০ সালে সংঘটিত মুন্ডাদের বিদ্রোহ উলগুলান অরণ্যের অধিকারের মূল ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে ১৭৮৯-১৭৯৫ তামাড় পরগনার বিদ্রোহ, ১৭৯৬-১৭৯৮ সালের রাহে ও মিল্লি পরগনার বিদ্রোহ, ১৮৫৮-১৮৯২ পর্যন্ত সর্দারদের মুলকুই লড়াই এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সাঁওতালদের হুল বিদ্রোহ জঙ্গলের অধিকারের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া হয়েছে কোল বিদ্রোহ, সিধু-কানুর হুল (১৮৫৫-৫৭), খেরোয়ারদের বিদ্রোহ। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত খুটকাট্টি গ্রাম, দামিনই-কো গ্রাম থেকে উৎখাত হওয়ার বিরুদ্ধে মুণ্ডারা বারবার লড়েছে। বীরসা মুণ্ডার জঙ্গলের অধিকারের লড়াই মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে চিত্রিত। এরপর ঝাড়খণ্ডী ও মাওবাদী আন্দোলনও সংগঠিত হয়েছে আদিবাসীদের দুরবস্থা নিরসনে ও জঙ্গলের অধিকারের প্রশ্নে। 

সমাধান

সম্প্রতি আদিবাসীদের অধিকার প্রশ্নে চাকরিতে সংরক্ষণ, শিক্ষার অধিকার, উপজাতি কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব প্রেরণ প্রভৃতি ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। যেসব আদিবাসীদের অনাহারে থাকতে হয় তাদের খাওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের জন্য পুলিশ, হোমগার্ড প্রভৃতি ক্ষেত্রে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে, আদিবাসী এলাকায় হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট প্রভৃতির প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আদিবাসীদের সমস্যার সমাধানে সরকার তৎপর হয়েছে।

উপসংহার

আদিবাসীরা যেহেতু ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা তাই আদিবাসীদের যথাযথ সম্মান দিয়ে তাদের অধিকারের প্রশ্নে যথাযথ অধিকার দান করে, দীর্ঘদিন ধরে শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে তাদের বাঁচিয়ে তুলতে পারলে সমগ্র সমাজের ও রাষ্ট্রের যে মঙ্গল হবে তা বলা বাহুল্য। কেননা বাঁচার অধিকার সব মানুষের মৌলিক অধিকার।

Leave a Comment