ভারতের মঙ্গলযাত্রা রচনা

ভারতের মঙ্গলযাত্রা রচনা
ভারতের মঙ্গলযাত্রা রচনা

ভূমিকা

মঙ্গল পৃথিবীর পরের গ্রহ-সূর্য থেকে চতুর্থ। গত ২৭শে আগস্ট (২০০৩) দুপুর ৩টে ২১ মিনিটে মঙ্গল ও পৃথিবীর দূরত্ব ছিল ৩৪,৬৪৬,৪১৮ মাইল। আনুমানিক ৬০,০০০ বছরের মধ্যে মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর এত কাছে আসেনি। দুনিয়া জুড়ে ছিল এই নিয়ে বিপুল উত্তেজনা। এমনকি মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে নানান অনুসন্ধানী দৃষ্টি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলোচনা-সম্ভাবনা সমস্ত বিষয় লোকমানসে প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনকি আগামী দিনে পৃথিবীর সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় মঙ্গল গ্রহে বসবাসের উপযোগী ক্ষেত্র সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।

অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য

মঙ্গল পৃথিবীর চেয়ে অনেক ছোটো। এর ব্যাস ৪২২০ মাইল। মঙ্গল সেকেন্ডে ২৪ কিমি বেগে ছুটে আমাদের ৬৮৭ দিনে একবার সূর্যকে ঘুরে আসে। এটি যে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাতে এর রাত ও দিন হচ্ছে আমাদের মতো। একবার ঘুরপাক খেতে এর সাড়ে চব্বিশ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ওখানে শীত-গ্রীষ্ম আছে, হাওয়াও আছে। মঙ্গলকে খালি চোখে লাল দেখায়। কেউ কেউ মনে করেন মঙ্গলের মাটিতে লোহা আছে, যা মরচে ধরে লাল হয়েছে। আবার কেউ বলেন, বালি থাকায় মঙ্গল লাল দেখায়। মঙ্গলের দু-মাথা বরফে ঢাকা। এমনকি শ্যাওলাও থাকতে পারে। এসব বৈশিষ্ট্য দেখে মঙ্গলে কোন ধরনের জীব ও গাছপালার অবস্থান সম্বন্ধে কেউ কেউ অনুমান করেন। প্যার্সিভ্যাল লোয়েল মনে করেন-মঙ্গলে যে শুধু প্রাণী আছে তাই নয়, তারা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান। তবে পরবর্তীকালে কেউ কেউ তা বিশ্বাস করেন না। মঙ্গলের উপগ্রহ দুটি। একটির নাম ফোবোস, সেটি মঙ্গল থেকে ৯৩৪৪ কিমি দূরে থেকে প্রতি ৭ ঘণ্টা ৩৭ মিনিটে একবার মঙ্গলের চারদিকে ঘুরে আসছে। এর ব্যাস ১৬ কিমি। অন্যটির ব্যাস এর অর্ধেক। তার নাম ডিমোস। সেটির অবস্থান মঙ্গল থেকে ২৩,৩৮৫ কিমি দূরে। ছোটো হলেও সেটি ফোবোসের মতো ক্ষিপ্রগতি নয়। মঙ্গলকে চক্কর দিয়ে আসতে তার ৩০ ঘণ্টা লেগে যায়।

মঙ্গল সম্বন্ধে নতুন উৎসাহ

মঙ্গলের এই পৃথিবীর কাছে আসা সম্বন্ধে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মঙ্গলের নিকটতম হওয়ার ঘটনাটা আসলে সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উল্কাপাতের মতো একটা মহাজাগতিক ঘটনা। শুধু বিশেষত্ব হল এই যে, এটা ঘটে বহু বহু বছর অন্তর। ঐ দিনটার আসল গুরুত্ব এইখানে যে, মানুষের বোধে মঙ্গল গ্রহ সম্বন্ধে একটা জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে মাত্র।

নাসা ঘোষণা করেছে ‘মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ার’ যা ১৯৯৭ থেকে ২০,০০০ বারের বেশি মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করেছে ও ১,২০,০০০ এর বেশি আলোকচিত্র পাঠিয়েছে তা এখন সাধারণ মানুষের অনুরোধ মতো ছবি পাঠাতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত, মঙ্গলের আকাশে এখন শুধু নাসা প্রেরিত মহাকাশ যান নয়, বিভিন্ন দেশের অনুসন্ধানী দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে।

রোভার

৭ই আগস্ট, ২০১২-তে নাসার গবেষণাগার থেকে মঙ্গলের জল হাওয়া বুঝতে চলমান এক গবেষণাগার ‘রোভার’-কে পাঠানো হয়েছে। নাসা জানিয়েছেন মঙ্গলে কিউরিওসিটির অভিযানের মেয়াদ দু বছর। এই চলমান গবেষণাগারটি নমুনা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও পৃথিবীতে তথ্য পাঠানোর কাজ করবে। এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী অনিতা সেনগুপ্ত। তিনি এ বিষয়ে জানিয়েছেন, মঙ্গলে প্রাণের সন্ধান করাই হল ‘রোভার’-এর কাজ। এক সময় মঙ্গল উন্ন ছিল, জলও ছিল। সেই জল এখন মঙ্গলের মেরু অঞ্চলে গিয়ে বরফ হয়ে রয়েছে। কিম্বা অণুজীবও থাকতে পারে। এই চলমান গবেষণাগার মঙ্গলে অবতরণের পর সঠিক পথেই কাজ করছে। রোভার সম্প্রতি যে তথ্য পাঠিয়েছে তাতে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন মঙ্গলে জল হয়তো ছিল। কারণ জলের স্রোতে পাথরের নুড়ি ভেসে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আগামীদিনে আরও আশার বাণী শোনাতে পারে।

ভারতের সাম্প্রতিকতম অভিযান

মঙ্গলযান (মার্স অরবিটার মিশন, সংক্ষেপে মম) ভারত তথা ইসরোর প্রথম মঙ্গল গ্রহ অভিযান এবং প্রথমেই সফল। বিশ্বে আগে কেউ যা পারেনি। দিনটা ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বুধবার। নির্ঘণ্ট মেনেই মঙ্গলযানকে লালগ্রহের কক্ষপথে বসিয়ে দিতে পেরেছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। ইসরোর জনসংযোগ অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ কার্ণিক বলেছেন, “এদিক থেকে আমরা নাসা, রাশিয়া, ইওরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাকেও টপকে গিয়েছি।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “মম কো মঙ্গল মিল গয়ি। মঙ্গল কো মম মিল গয়া।” তিনি আরও বলেন, “ভারতের বিজ্ঞানীরা ইতিহাস তৈরি করেছেন। অল্প সাধ্য নিয়ে প্রথম বারেই এমন সিদ্ধিলাভ!” জাপান বা চিন যা পারেনি, বহুগুণ অর্থ খরচ করেও আমেরিকা এক বারে যা করে দেখাতে পারেনি ভারত মাত্র সাড়ে চারশ কোটি টাকা খরচ করে তা করে দেখাল। বিশ্বের চতুর্থ মহাকাশ সংস্থা হিসেবে এই মঙ্গল অভিযান স্মরণীয়।

গত ৫ নভেম্বর, ২০১৩ শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করার পর ২৫ দিন পৃথিবীর চারপাশে পাক খেয়েছিল ১৩৫০ কেজি, ওজনের এই মঙ্গলযান। একটু একটু করে লাফিয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছিল পৃথিবী থেকে। তারপর ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বরের সন্ধিক্ষণে এক লাফে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাকাপাকিভাবে মঙ্গল গ্রহের দিকে রওনা দিয়েছিল।

ইসরোর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, নাসার মতো উন্নত রকেট তাদের নেই। তাই শুরু থেকেই পেরোতে হয়েছে বহু বাধা। কিন্তু অভিযান উতরে গিয়েছে প্রযুক্তির জোরে।

মঙ্গলগ্রহের বিভিন্ন তথ্য

বর্তমানে মঙ্গল গ্রহ অভিযানের মাধ্যমে নানান তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলি হল-(১) বিগত দিনগুলিতে অন্তত কোটি বছরে মঙ্গলের বুকে যে প্রাকৃতিক দুর্বিপাক ঘটেছে তার সঙ্গে পৃথিবীর দুর্বিপাকের মিল আছে। (২) মঙ্গল ও পৃথিবীর পাথরের মধ্যে মিল আছে। বিশেষত পাথরের সিলিকা উপাদানের দিক থেকে। এই প্রমাণ মিলেছে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে আসা উল্কাখণ্ড পরীক্ষা করে। (৩) ভয়াবহ বন্যার কারণে মঙ্গলে প্রাণের বিনাশ হয়েছে একশো কোটি বছর আগে। (৪) মঙ্গল গ্রহে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় অনেক বেশি সময় ধরে হয়। (৫) মঙ্গল গ্রহে ধূলোর পরিমাণ অনেক বেশি। (৫) এখন প্রাণ না থাকলেও জল থাকায় প্রাণ থাকা অসম্ভব ছিল না। (৭) মঙ্গলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রধান গ্যাস বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

উপসংহার

মহাকাশ গবেষণায় ভারতের মঙ্গল গ্রহ অভিযান এক যুগান্তকারী এবং সফলতম পদক্ষেপ। ইসরোর চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেছেন যে মঙ্গল সম্পর্কে শীঘ্রই তাঁরা পৃথিবীবাসীকে আরও গুরুত্বপূর্ণ খবর জানাতে পারবেন যা মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতকে সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছে দেবে। নাসার মঙ্গল অভিযানের খরচের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ খরচ করে ভারতের এই মঙ্গল অভিযান আমাদের গর্বিত করেছে।

Leave a Comment