![]() |
ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ রচনা |
ভূমিকা
যে জলের অপর নাম জীবন সেই জল আজ দূষিত। আজ দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে যে, বিশুদ্ধ জল, মুক্ত বায়ু সেবন মানুষের কাছে দুরাশামাত্র। আমাদের শরীরে যে সব রোগ বাসা বাঁধে তার মধ্যে জলবাহিত রোগই বেশি। তাই বিশুদ্ধ জল সুন্দর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয়। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ জলে যে দূষণের কথা বলা হয়, তার মধ্যে প্রধান হল আর্সেনিক দূষণ। এই দূষণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বহু মানুষ মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে। তাই এ ব্যাপারে এখনই সদর্থক ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠবে-তা বলা বাহুল্য।
আর্সেনিক দূষণ
জলদূষণের অন্যতম দিক হল-আর্সেনিক দূষণ। ধাতুঘটিত দূষণই হল আর্সেনিক দূষণ। ভূগর্ভস্থ জলে নানা রকমের খনিজ পদার্থ সমন্বিত আর্সেনিক যৌগ মাটির স্তরভেদ করে এসে মেশে। আর্সেনিক যৌগ সোনা, রূপা, লোহা ইত্যাদি ধাতুর সঙ্গে সহাবস্থান করে। মুখ্যত তিনটি প্রধান খনিজ পদার্থে আর্সেনিক বর্তমান। আর্সেনিক সালফাইড (AsS), আর্সেনিক ট্রাই সালফাইড (As₂S₁), আয়রন আর্সেনিক সালফাইড (FeAsS) ইত্যাদি খনিজ বস্তু থেকে আর্সেনিক মৌল দ্রবীভূত হয়ে ভূগর্ভস্থ জলে মিশে যায়। পানীয় জলে যদি প্রতি লিটারে ০.০৫ বা তার কম আর্সেনিক থাকে তবে তা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না। এর বেশি থাকলে আর্সেনিক দূষণ-ঘটিত রোগ ক্রনিক আর্সেনিকোসিস (Chronic Arsenicosis) দেখা যায়।
দূষণের কারণ
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সচিব জানিয়েছেন-রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গ্রাম ও শহরে ভূগর্ভ থেকে ব্যাপক হারে জল তোলার জন্য এই দূষণের মাত্রা ছড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বহুতল বাড়িগুলি ব্যাপক হারে জল তুলছে মাটি থেকে। সেজন্য মাটির এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আর্সেনিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। তৃতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কৃষি ব্যবস্থায় যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধ। এরই কিছু অংশ জলাধার ও বিলে মিশে গিয়ে এবং তা ভূগর্ভস্থ জলে সঞ্চিত হওয়ার ফলে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। চতুর্থত, জল-বিভাজিকা নিয়ন্ত্রণ ঠিক না থাকার কারণে যে পরিমাণ জল মাটির নীচে সঞ্চিত হওয়ার প্রয়োজন, তার থেকে কম সঞ্চিত হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। ফলে ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রা স্বাভাবিক হারে কমছে এবং আর্সেনিকের মাত্রা তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং আর্সেনিক নামক মারাত্মক বিষ, যা পারদের থেকে চার গুণ শক্তিশালী তা মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
দূষণের প্রতিক্রিয়া
আর্সেনিকের বিষক্রিয়াগুলি হল-বমি, পেটের যন্ত্রণা, জণ্ডিস, কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস, মাথার যন্ত্রণা, হাতে ও পায়ে কালো দাগ, কুন্ঠের মতো ঘা ইত্যাদি। এই বিষক্রিয়ার চিহ্ন, আক্রান্ত ব্যক্তির নখ, চুল ও প্রস্রাব পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে। এই দূষণের প্রতিক্রিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে মানবদেহে যে লক্ষণগুলি দেখা যায়, তা হল-চামড়ায় কালো দাগ, হাতে বা পায়ের তালুতে চামড়া শক্ত ও খসখসে হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধাপে চামড়ায় সাদা ও কালো ছিটে দাগ, হাতে ও পায়ের তালুতে শক্ত গুটি ওঠা, পা ফুলে যাওয়া, প্রান্তীয় স্নায়ুরোগ, কিডনি ও লিভারের জটিলতা দেখা দেয়। তৃতীয় পর্যায়ে প্রকট হয় দেহের প্রান্তদেশীয় অঙ্গের পচন, চামড়া, মূত্রথলী ও ফুসফুসের ক্যান্সার, লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গের দূষিত অঞ্চল
১৯৮৩ সালে ২৪ পরগনার কিছু গ্রামে প্রথম এই দূষণের খবর পাওয়া যায়। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যালের বিশেষজ্ঞগণ পরীক্ষা করে আর্সেনিক দূষণ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন ১৯৮৩ সালে। বর্তমানে পশ্চিমবাংলায় আক্রান্ত জায়গাগুলি হল-মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ অঞ্চল পরগনা, কলকাতার কিছু অংশ, বর্ধমানের কিছু অংশ এবং হাওড়া ও হুগলির কিছু অংশ। বিগত দুই দশকের সমীক্ষায় দেখা গেছে- পশ্চিমবাংলায় প্রায় ত্রিশ লক্ষের বেশি মানুষ এই দূষণের শিকার। রাজ্যে ৬৮টি ব্লক এই দূষণের জন্য চিহ্নিত হয়েছে।
প্রতিরোধের উপায়
এই দূষণের ক্ষেত্রে করণীয় দিকগুলি হল- (১) অবিলম্বে ভূগর্ভস্থ জল তোলায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। (২) বাংলাদেশের মতো পুকুরের জলকে পরিশুদ্ধ করে তা পানের জন্য ব্যবহার করা। (৩) আর্সেনিক দূষিত এলাকা চিহ্নিত করে সেখানকার নলকূপগুলিকে ব্যবহারের অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা এবং সেক্ষেত্রে শোধিত পানীয় জল সরবরাহ করা। (৪) শুধু সম্মেলন করে নয়, প্রয়োজনীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে প্রতিবিধানের ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী কাজ করা জরুরি। (৫) আর্সেনিক আক্রান্ত প্রতিটি ব্লকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালগুলিতে পৃথক আর্সেনিক বিভাগ চালু করা। সেখানে রোগীদের নখ, চুলের পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও চিকিৎসার ব্যকথা রাখা। (৬) বাংলাদেশ যেভাবে এই দূষণের প্রতিবিধানে সফল হয়েছে, তার মডেল অনুসরণ করা। (৭) আর্সেনিক দূষণের ব্যাপারে জনগোষ্ঠীকে অবহিত করা ও তাদের সচেতন করা।
উপসংহার
সভ্যতার অগ্রগতি যেমন হচ্ছে, সেইসঙ্গে সেই সভ্যতার উপসর্গগুলিও বেশি করে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তজ্জনিত সমস্যার সমাধানে যে সব উপায়গুলি আশু নির্ধারিত হচ্ছে, তাতে ক্ষতির দিকগুলি খতিয়ে দেখার সুযোগ থাকছে না। ফলে নানান ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। আর্সেনিক দূষণও সেই ধরনের একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (Side effect)। আমাদের দেশে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার অভাব এবং রোগ এলে তার প্রতিবিধান করব—এই মানসিকতার ফলে শুধু আর্সেনিক দূষণ নয়, যে কোন দূষণের মাত্রাই বাড়ছে। এ থেকে বাঁচতে গেলে সর্বাগ্রে চাই সচেতনতা এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তার যথাযথ মূল্যায়ন।