![]() |
মহিলা সংরক্ষণ বিল ও নারীর অধিকার রচনা |
ভূমিকা
ভারতবর্ষে মহিলা সংরক্ষণ বিল ও নারীর অধিকার প্রসঙ্গে রাজনীতি বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তা চর্চিত বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রশ্নটা সরগরম হওয়া নিয়ে নয়, বরং সমগ্র দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে মহিলাদের অধিকার দিয়ে তাদেরকে উন্নয়নের শরিক করা নিয়ে। আসলে আমাদের দেশে মাঝে মাঝে একটা ইস্যু বা হুজুগ তৈরি হয়, তারপর তা নিয়ে সংবাদমাধ্যম অনেক প্রচার করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই আবার নতুন ইস্যু এসে পুরাতনকে চাপা দিয়ে দেয়। এভাবেই আমরা দেখতে, শুনতে এবং অবশ্যই সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই নারীর অধিকার, তাদের সার্বিক ক্ষমতায়ণ প্রভৃতি বিষয়ে সংরক্ষণ আইন কতটা কার্যকরী প্রক্রিয়া-সে বিষয়ে কিছু সন্দেহ থেকেই যায়।
নারীর অবস্থান
প্রাচীন ভারতে শাস্ত্র রচয়িতা মুনি-ঋষিরা নারী স্বাধীনতা পছন্দ করতেন না এবং সেকারণে তাঁরা স্ত্রী-বিদ্বেষী ছিলেন। তাই রামায়ণ, মহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণে নারী নিন্দার ছড়াছড়ি। আবার প্রয়োজনে নারীবন্দনার ইতিহাসও রয়েছে। যেজন্য শাস্ত্রকারগণ দেবী সরস্বতীর কাছে বর প্রার্থনা করেছেন, দেবী চণ্ডীকে অসুর দমনের জন্য ব্যবহার করেছেন, দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী কিম্বা কুন্তীর কুমারী বয়সে পুত্রবতী হওয়া সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেন নি। অর্থাৎ নারী সম্পর্কে দ্বৈত মনোভাব তাঁদের ছিলই। মধ্যযুগে নারীরা ছিল অসূর্যম্পশ্যা, পর্দানসীন, অন্তঃপুরচারিনী। এর মূলে ছিল শিক্ষার অভাব, সংস্কারাচ্ছন্নতা, ধর্মপ্রবণতা, আবেগময়তা প্রভৃতি। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহ, কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ প্রভৃতির চাপে নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি আধুনিক যুগে শিক্ষার প্রসারেও নারীরা অধিকার খুব বেশি পায়নি। এখনো নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত হয়, এমনকি নারীরাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতির কিম্বা অধিকার লাভের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
বিলের বিষয়
এই প্রেক্ষিতে নারীর ক্ষমতায়নের নিরিখে মহিলা সংরক্ষণ বিলের প্রয়োজনীয়তা বিলের বিষয় উপলব্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিক মহিলা সংরক্ষণ বিলটি আসলে সংসদীয় গণতন্ত্রে মহিলাদের আসন সংরক্ষণের বিষয়ে একটি অধিকার প্রদান সম্পর্কিত বিষয়। যে বিলে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় ৩৩.৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। পালাক্রমে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই আসন সংরক্ষিত হবে এবং এই অধিকার প্রদানের সময়সীমা পনের বছর ও তা পরে বর্ধিত হতে পারে প্রয়োজনানুযায়ী।
বিল পেশ
মহিলা সংরক্ষণ বিলটি ১৯৯৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর প্রথম লোকসভায় পেশ হয়। কিন্তু তখন তা কয়েকজন সাংসদের বাধায় পাশ হতে পারেনি। বিলটি আবার ১৯৯৮ সালের ১৩ই জুলাই এবং পরে ২০০৩, ২০০৫, ২০০৮ সালে সংসদে পেশ হলেও তা পাশ হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ২০১০-এর ৯ই মার্চ রাজ্যসভায় বিলটি ১৮৬-১ ভোটে পাশ হয়। এর আগে এটি ২০১০-এর ২৫শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। এখনো তা লোকসভায় উত্থাপিত হয়নি এবং তা নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে নানান কথা উত্থাপিত হচ্ছে।
বিলের পক্ষে
এই বিলের পক্ষে যে অভিমত সেগুলি হল: (এক) দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে যদি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে শরিক না করা যায়, তাহলে সার্বিক উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। (দুই) শুধু পুরুষেরাই দেশ ও সমাজের উন্নতি ঘটাতে পারে-এই ধারণা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। (তিন) বিশেষ করে সমাজে নারীপুরুষের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য ও হীনমন্যতা দূরীকরণে নারীদের অধিকার দান প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। (চার) সংরক্ষণ-এর মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতা না দিলে কখনোই পুরুষেরা নারীদের সেই বাঞ্ছিত ক্ষমতা দেবেন না। (পাঁচ) যাঁরা এতদিন অত্যাচারিত হয়ে আসছেন, তাঁরা যদি আইনী ক্ষমতা না পান তাহলে অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। (ছয়) নারীরা যেহেতু বাল্য কৈশোরে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানের অধীন তাই এই অধীনতা থেকে তাঁদের স্বাধীনতায় উত্তরণের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ একটা মাধ্যম।
বিপক্ষের যুক্তি
আবার এইসব যুক্তির বিরুদ্ধেও উঠে এসেছে নানান যুক্তি। সেগুলি হল: (এক) এই বিল আসলে একটি রাজনৈতিক চমক মাত্র। কেননা আইন করে শুধু আসন সংরক্ষণ করলেই নারীর অধিকার ফিরে আসবে না। (দুই) এই বিলের মাধ্যমে কিছু শিক্ষিত উচ্চশ্রেণির মহিলারা বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাবেন এবং সেই সুযোগে তাঁরাও আখের গুছিয়ে নিতে ইতস্তত করবেন না। কথায় আছে, যে লঙ্কায় যায় সেই রাবণ হয়। তাছাড়া ব্যক্তিস্বার্থ এত বেশি মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠছে তাতে সামগ্রিক স্বার্থ অপেক্ষা নিজেদের আখের গোছানোই এই বিলের দ্বারা সম্ভব হবে কিছু মহিলার। (তিন) আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতা পেলেও সেই ক্ষমতা আসলে নিয়ন্ত্রণ করবে কোনো পুরুষ। (চার) অশিক্ষিত সাধারণ নারী, গ্রামীণ নারী, দলিত, সংখ্যালঘু নারীরা অসচেতনতার অভাবে এই সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই বিপক্ষের অভিমত হল, এই বিল আসলে ক্ষমতার পরিবর্তন, বিকেন্দ্রীকরণ নয়।
উপসংহার
শুধু সংরক্ষণ করলেই যেমন নারীর অধিকার লাভ সম্ভব নয়, তেমন এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াটাও ঠিক হবে না। অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে সব শ্রেণির মানুষের সমানাধিকার জরুরি তা সে যে জাতি, ধর্ম, ভাষাভাষী কিম্বা নারী পুরুষ যাই হোক্ না কেন। এর জন্য চাই সদিচ্ছা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো রাজনৈতিক চমক সৃষ্টি করে কিম্বা ভোটের জন্য রাজনীতি না করে সমাজের সর্বস্তরের অবহেলিত মানুষদের যথাযথ ক্ষমতা প্রদান করলে, নারী কেন সব মানুষই নিজেদের ক্ষমতা পেলে সমাজ তথা দেশ যে অগ্রগতির পথে যাত্রা করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।