শিক্ষাবিস্তারে পাঠাগারের গুরুত্ব রচনা

শিক্ষাবিস্তারে পাঠাগারের গুরুত্ব রচনা
শিক্ষাবিস্তারে পাঠাগারের গুরুত্ব রচনা

ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথের উক্তি- “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে ভূমিকা সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরীর তুলনা হইত।” গ্রন্থ হল এই মনোবিকাশের অন্যতম মাধ্যম এবং মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। শুধু সঙ্গীই নয়, তার জ্ঞান আহরণের প্রধান উৎসও গ্রন্থ। সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করা যায়। আর গ্রন্থাগার হল এ সব কিছুর সংগ্রহশালা, যেখান থেকে আগ্রহশীল ব্যক্তিমাত্রেই বন্ধুর মতো অবিরত সাহায্য পান। গ্রন্থাগার বা পাঠাগার গ্রন্থের ভান্ডার, জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সংগ্রহ করে গ্রন্থাগার অপেক্ষা করে থাকে। মানুষ সেই জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন করে জ্ঞানের মণিমুক্তা আহরণ করে। সুতরাং শিক্ষা ও পাঠাগার অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। 

পাঠাগার কী

‘পাঠাগার’ শব্দটির মধ্যেই তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। যেখানে অসংখ্য গ্রন্থ একটি আগারের মধ্যে একত্রে অবস্থান করে ও পাঠের জন্য বহু পাঠক একত্রিত হয়, তারই নাম পাঠাগার। ইংরেজিতে যাকে Library বলে, ‘পাঠাগার’ তারই বাংলা প্রতিশব্দ। মানুষের সভ্যতায়, তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমপ্রসারে গ্রন্থের ভূমিকা যত গুরুত্ব লাভ করেছে, মানুষ ততই পাঠাগার স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করেছে। শ্রুতির যুগ থেকে মানুষ যখন লিপির যুগে পদার্পণ করেছে মানুষ সে সময় থেকেই পাঠাগারের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে।

উৎপত্তি

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের জ্ঞান-পিপাসা ছিল তীব্র। কিন্তু তখন গ্রন্থাগার বা পাঠাগার ছিল না। ভারতবর্ষে প্রাচীনকালে সৃষ্টি হয়েছিল বেদ। বেদ ছিল শ্রুতি সাহিত্য। মানুষের স্মরণ-শক্তিকে আশ্রয় করে সেকালে জ্ঞানচর্চা চলত, সেদিন শ্রুতিধর পণ্ডিতরাই ছিলেন জ্ঞানাধার। কিন্তু তখনও অক্ষর সৃষ্টি হয়নি। পরবর্তীকালে মানুষের জ্ঞানচর্চা অক্ষরের বাঁধনে বন্দী হল। ভূর্জপত্র ও তালপত্রে মানুষ তার জ্ঞানচর্চার স্বাক্ষর রেখে দিল। এরপর বহু সাধনার পর সৃষ্টি হল ছাপাখানা ও গ্রন্থ লিখিত হতে থাকল। আর খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতেই মানুষ তৈরি করল গ্রন্থাগার এবং ইতালির রোম শহরে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হল। সর্বসাধারণ যাতে গ্রন্থাগার থেকে জ্ঞানলাভ করতে পারে তার জন্যই গ্রন্থাগারের সৃষ্টি। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-‘পেটের ভাত পশুর পক্ষে যথেষ্ট, মানুষের পক্ষে নয়।’ কারণ মানুষ যা চিন্তা করতে পারে, পশু তা পারে না। আর তা পারে না বলেই মানুষের চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে গ্রন্থ ও পাঠাগার।

পাঠাগারের বিভাগ

পরিচালনার দিক থেকে পাঠাগারকে ভাগ করা হয় কয়েকটি শ্রেণিতে। যেমন-এক সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় পাঠাগার। দুই, বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত পাঠাগার। তিন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত পাঠাগার। চার, স্কুল ও কলেজ পরিচালিত পাঠাগার। পাঁচ. বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক সংগৃহীত পুস্তকাবলীর দ্বারা গঠিত পাঠাগার।

গতানুগতিক শিক্ষার পাঠাগার

পাঠাগার স্কুল-কলেজের গতানুগতিক শিক্ষার সহায়ক যেমন, তেমনি পরিপূরকও বটে। তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষার যেখানে শেষ, প্রকৃত শিক্ষার সেখানে শুরু। ডিগ্রি পাবার পরেই প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বশিক্ষিত হবার যোগ্যতা জন্মে। আর এই স্বশিক্ষিত হবার পীঠস্থান হল পাঠাগার।

কল্যাণমুখী শিক্ষায় পাঠাগার

গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে সার্বজনীন শিক্ষার উপর। গণতান্ত্রিক চেতনা উন্মেষে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। সচেতন মানুষের পবিত্র স্বাধীনতার বোধটি উজ্জীবিত হতে পারে একমাত্র পাঠাগারের ভূমিকা যথার্থভাবে পালনের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে পাঠাগারই একমাত্র সামাজিক মিলনকেন্দ্র, যেখান থেকে সর্বব্যাপী এক আলোকের ঝরণাধারা বইয়ে দেওয়া যায়—যে আলোয় মানুষ পরিপূর্ণভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে।

সাম্প্রতিক বিশ্বে শিক্ষা নিয়ে চতুর্দিকে অগ্রগতির কলকোলাহল ধ্বনিত হচ্ছে। শিক্ষাকে যতই পাঠাগারমুখী করে তোলা যাবে, ততই শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও শিক্ষার পূর্ণতা। স্কুল-কলেজে না গিয়েও আমাদের নিরক্ষরতা দূরীভূত হতে পারে এবং তা পারে একমাত্র পাঠাগারে গিয়েই। আর এই শিক্ষার মধ্যেই যথার্থ আনন্দ ও আত্মার মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

বয়স্ক শিক্ষা ও পাঠাগার

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণের জন্যই শুধুমাত্র পাঠাগার অপরিহার্য নয়। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্যও পাঠাগারের প্রয়োজন সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। কিন্তু যে সমস্ত বয়স্ক মানুষদের জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ আসেনি তাদেরও নানা বিষয়ে জানবার আগ্রহ ও প্রয়োজন আছে। এসব ক্ষেত্রে একমাত্র পাঠাগারই বন্ধুর মতো ভূমিকা পালন করে।

পাঠাগার ও জনশিক্ষা

পাঠাগার জনশিক্ষার একটি বিশিষ্ট মাধ্যম। জনশিক্ষা বলতে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন। বিশেষ করে গ্রামে অল্প শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকের আছে জ্ঞানার্জনস্পৃহা এবং তাদের ঐ স্পৃহা মেটাতে পাঠাগারের ভূমিকা অসামান্য। সুতরাং জনশিক্ষা বা গণশিক্ষার ক্ষেত্রেও পাঠাগার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা

সুদূর অতীতের অতল গর্ভে যা চিরনিমজ্জিত তার স্বরূপ ও জীবন্ত চিত্র বর্তমান মানুষের মনের দ্বারে হাজির করতে পারে পাঠাগার। তাই পাঠাগার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ভাব-চিন্তার যোগ-মিলনের অক্ষর-নির্মিত সেতু। সুস্থ, সর্বাঙ্গীণ, সভ্য মানবজীবন গড়ে তুলতে পাঠাগারের ভূমিকাটি আজ সর্বদেশে প্রয়োজনীয়তা ও সর্বজাতির মধ্যে স্বীকৃত হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষায়তনে স্বতন্ত্র পাঠাগারের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া জেলাভিত্তিক ও গ্রামভিত্তিক স্তরেও আমাদের দেশে পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সবকয়টি শিক্ষা কমিশনও দেশে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

উপসংহার

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা যত বেশি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করবো দেশের তত বেশি উপকার হবে।’ পাঠাগার শুধু নিষ্ক্রিয় শিবের মতো শবাসনশায়ী নয়, নৃত্যরতা শ্যামার পদপাদের ছন্দ ফুটে ওঠে পাঠাগারের প্রতিটি কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। মোট কথা, মানব সভ্যতার বিবর্তনে ও বিকাশে, বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পাঠাগারের প্রয়োজন অপরিহার্য। যদি শিক্ষার আলো দেশের সর্বস্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কাছে গিয়ে না পৌঁছায়, তবে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উপর নির্ভর করে জাতীয় প্রগতির কথা চিন্তা করা যায় না। আর এ কাজে মানুষের সবচেয়ে বড়ো সহায়ক পাঠাগার। তাই পাঠাগার আধুনিক মানুষের সর্বাপেক্ষা উপকারী বন্ধু, হৃদয়বান সঙ্গী ও প্রজ্ঞাবান দিশারী।

Related Keyword
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অনুচ্ছেদ রচনা
ছাত্র জীবনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনুচ্ছেদ রচনা
সমাজে গ্রন্থাগারের ভূমিকা
বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা
শিক্ষায় গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা
লাইব্রেরির গুরুত্ব
পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা রচনা ২০ পয়েন্ট

Leave a Comment