শিক্ষামনোবিজ্ঞান প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester WBCHSE

১। দর্শন সংবেদন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
অথবা, চিত্রের সাহায্যে দর্শন সংবেদনের বিভিন্ন পর্যায়গুলি ব্যাখ্যা করে। দেখাও।
অথবা, দর্শন সংবেদন সম্পর্কে চিত্র-সহ সংক্ষিপ্ত চীকা লেখো।
জ্ঞানার্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয় বা পাঁচটি ইন্দ্রিয়। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সংবেদন হয়, তাই-ই হল ইন্দ্রিয় সংবেদন। আর এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় হল চোখ। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা’ এই উদ্দেশ্যটি পূরণ করার ক্ষেত্রে চোখ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আলোচ্য অংশে চোখের মাধ্যমে দর্শন সংবেদন কীভাবে হয়, তা আলোচনা করা হল-
দর্শনেন্দ্রিয় বা চক্ষুর মাধ্যমে দর্শন সংবেদন
চোখ হল দর্শন সংবেদনের ইন্দ্রিয়। আমরা যে বস্তুকে দেখি, তার থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মিগুচ্ছ স্বচ্ছ কর্নিয়া ও অ্যাকুয়াস হিউমর ভেদ করে তারারন্দ্রের মধ্য দিয়ে লেন্স-এর উপর পড়ে। লেন্স থেকে আলো প্রতিসৃত হয়ে ভিট্রিয়াস হিউমর ভেদ করে রেটিনায় পড়ে। রেটিনায় দৃষ্ট বস্তুটির একটি ক্ষুদ্র ও উলটো প্রতিবিম্ব গঠিত হয়। এটি ক্যামেরার মতো কাজ করে। রেটিনায় আলোক সংবেদী রড কোশ ও কোণ কোশ থেকে আলোক অনুভূতি অপটিক্ স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের দর্শনকেন্দ্রে পৌঁছোয়। মস্তিষ্কের বিশেষ প্রক্রিয়ায় রেটিনায় বিপরীত প্রতিবিম্বটি সোজা হয়ে যায় এবং আমাদের মনের মধ্যে বস্তুটির রং, আকার, আয়তন ও অবস্থান সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা সৃষ্টি হয়। এর ফলে দর্শন সংবেদন ঘটে। এই জাতীয় সংবেদনের ফলে বাহ্যিক জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায়।
অক্ষিপেশি (Eye muscle): চোখের মধ্যে অবস্থিত অক্ষিগোলকটি। অক্ষিপেশির দ্বারা অক্ষিকোটরের। সঙ্গে যুক্ত থাকে, বিভিন্ন অক্ষিপেশিগুলি হল-রেকটাস পেশি (4টি), লিভেটর। পেশি (1টি), অবলিক পেশি (২টি), অক্ষিগোলকের নাড়াচাড়ার ক্ষেত্রে অক্ষিপেশির সংকোচনের ভূমিকা আছে।
ভ্রূ (Eyebrow): উপরের দিকের নেত্রপল্লবের উপরে ও অক্ষিকোটরের। পরিধি বরাবর যে বাঁকানো ঘন লোমের সারি থাকে, তাকে ভূ বলে। ভূ-এর। কাজ হল-সরাসরি ঘাম, ধুলোবালি ইত্যাদিকে চোখের মধ্যে প্রবেশ করতে না দেওয়া।
নেত্রপল্লব (Eyelids): চোখের উপরে ও নীচে একটি করে পেশিময়। পাতলা পাতার মতো পর্দা থাকে এটিই হল নেত্রপল্লব। প্রতিটি নেত্রপল্লবের। মুক্ত প্রান্তে একসারি করে লোম থাকে, এগুলিকে অক্ষিপক্ষ বা Eyelash বলে।। নেত্রপল্লবের কাজ হল চোখকে ঢেকে রাখা ও ধুলোবালি থেকে রক্ষা করা। দর্শনেন্দ্রিয় বা এই চক্ষুর মাধ্যমে আমরা কোনো একটি বস্তু কত দূরে। আছে, সে সম্পর্কেও ধারণা করতে পারি। শুধু তাই-ই নয়, একই বস্তুর বিভিন্ন। রঙের মধ্যেও পার্থক্য করতে পারি। তাই দর্শনেন্দ্রিয়ের এই বিভিন্ন গুণ বা | বৈশিষ্ট্যের জন্য জ্ঞানার্জনের দিক থেকে চোখের গুরুত্ব অনেক বেশি। এই সমস্ত। কারণের জন্য দেখা যায় যে, সমস্তরকম শিক্ষণ-শিখন কার্যের ক্ষেত্রে দর্শনেন্দ্রিয়ের ব্যবহার অনেক বেশি হয়ে থাকে।
২। কানের গঠন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
কানের গঠন
আমাদের শ্রবণ অঙ্গ কান। কানের মাধ্যমেই শ্রবণজাত সংবেদনের সৃষ্টি হয়। তাই শ্রবণজাত সংবেদন সম্পর্কে জানতে গেলে কানের গঠন সম্পর্কে আগে জানা প্রয়োজন।
মানুষের কান প্রধান তিনটি অংশে বিভক্ত থাকে।
[1] বহিঃকর্ণ (External ear)
বহিঃকর্ণ তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা- কানের পাতা বা কর্ণছত্র (Pinna), বহিঃকর্ণ নালি বা কর্ণকুহর (External Auditory Canal), কর্ণপটহ (Tympanic Membrane) I
- কানের পাতা বা কর্ণছত্র (Pinna): কর্ণছত্র মস্তিষ্কের দু-পাশে অবস্থিত। এর কাজ হল শব্দতরঙ্গ সংগ্রহ করে তা কর্ণকুহর বা বহিঃকর্ণ নালির মধ্যে প্রেরণ করা।
- বহিঃকর্ণ নালি বা কর্ণকুহর (External Auditory Canal): এটির অবস্থান কর্ণছত্রের কেন্দ্র থেকে কর্ণপটহ পর্যন্ত। কর্ণকুহরের কাজ হল শব্দতরঙ্গকে কর্ণপটহে বহন করে নিয়ে যাওয়া।
- কর্ণপটহ (Tympanic Membrane): বহিঃকর্ণ নালি বা কর্ণকুহরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি পাতলা পর্দাই হল কর্ণপটহ।
[2] মধ্যকর্ণ (Middle ear)
কর্ণপটহ এবং অন্তঃকর্ণের বাইরের দিকের প্রাচীরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি বায়ুপূর্ণ প্রকোষ্ঠ হল মধ্যকর্ণ। এই মধ্যকর্ণের মধ্যে তিনটি অস্থি বা হাড় আছে। সেগুলি হল- মেলিয়াস, ইনকাস, স্টেপিস। এই তিনটি অস্থির মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ কর্ণপটহ থেকে অন্তঃকর্ণে প্রেরিত হয়।
এ ছাড়াও আছে ইউস্টেচিয়ান নালি (Eustachian Tube) যা মধ্যকর্ণ ও গলবিলের মাঝে অবস্থান করে বায়ুর চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।
[3] অন্তঃকর্ণ (Internal ear)
এটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা- কক্লিয়া (Cochlea) ও ভেস্টিবিউলার যন্ত্র (Vestibular apparatus) | কক্লিয়ার কাজ হল শ্রবণ অনুভূতি গ্রহণ করে তা মস্তিষ্কে প্রেরণ করা। আর Vestibular apparatus-এর মধ্যে থাকে অর্ধবৃত্তাকার নালি (Semicircular Canals), অটোলিথ যন্ত্র (Otolith Organs)। অন্তঃকর্ণের মধ্যে অবস্থিত এই অর্ধবৃত্তাকার নালি ও অটোলিথ যন্ত্রের কাজ হল-দেহের ভারসাম্য রক্ষা করা ও নিয়ন্ত্রণ করা।
৩। শ্রুতি বা শ্রবণ সংবেদন সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
শ্রবণ সংবেদন
মানবদেহে কর্ণের মাধ্যমে যে সংবেদন সৃষ্টি হয় তাই হল শ্রবণ সংবেদন, কানের বিভিন্ন অংশগুলির মাধ্যমে কীভাবে শ্রবণ সংবেদনের সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে অলোচনা করা হল-
বাইরে থেকে আগত শব্দতরঙ্গ কর্ণছত্রের মাধ্যমে সংগৃহীত হয় এবং তা বহিঃকর্ণের নালীর মধ্য দিয়ে এসে কর্ণপটহে ধাক্কা মারে। এর ফলে কর্ণপটহের মধ্যে একধরনের কম্পন উদ্ভূত হয়। এরপর কর্ণপটহ থেকে শব্দতরঙ্গ মধ্যকর্ণের মধ্যে আসে। মধ্যকর্ণের মধ্যে অবস্থিত মেলিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস এই তিনটি অস্থির দ্বারা শব্দতরঙ্গ বাহিত হয়ে এসে অন্তঃকর্ণের কক্লিয়ার মধ্যে থাকা একধরনের তরলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় অন্তঃকর্ণের মধ্যে অবস্থিত কিছু রোমশ কোশগুলিকে উদ্দীপিত করে থাকে। এরপর এই উদ্দীপনা অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে পৌঁছোয়। এর ফলে আমরা শুনতে পাই। এইভাবেই কানের মাধ্যমে শ্রবণ সংবেদন ঘটে থাকে।
সবশেষে, বলা যায় কানের এতরকম গুণের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। তবে জন্মগতভাবে সম্পূর্ণ কালা বা বধিরদের ভাষার বিকাশ না হওয়ায় সেই শিশুরা কথা বলতেও শেখে না, অর্থাৎ তারা বোবা বা মূক-এ পরিণত হয় এবং অনেকক্ষেত্রে প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণে অসমর্থ হয়।
৪। নাসিকার গঠন ও ঘ্রাণ সংবেদন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।
নাসিকার গঠন ও ঘ্রাণ সংবেদন
জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির মধ্যে নাসিকা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের জন্য সৃষ্ট সংবেদন হল- গন্ধ (Olfactory Sensation)|
নাকের সাহায্যে আমরা ঘ্রাণ বা গন্ধ অনুভব করি, তাই নাককে বলা হয় ঘ্রাণ গ্রহণের ইন্দ্রিয়। নাকের মধ্যে অবস্থিত ঝিল্লি বা ত্বক স্নায়ুকোশ দ্বারা গঠিত। ঘ্রাণ হল এক ধরনের রাসায়নিক অনুভূতি, যখন কোনো গন্ধময় গ্যাসীয় কণা নাকে এসে প্রবেশ করে, তখন স্নায়ুকোশে একপ্রকার রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটে এবং গন্ধবাহী স্নায়ু মস্তিষ্কের ঘ্রাণ সংবেদনকেন্দ্রে সেই উদ্দীপনা বয়ে নিয়ে যায়, তখনই ঘ্রাণের সংবেদন সৃষ্টি হয়।
সাধারণত ঘ্রাণ বায়ুর সঙ্গে মিশে শ্বাসগ্রহণকালে বহিঃনাসারন্দ্রে প্রবেশ করে। বহিঃনাসারন্দ্রের মধ্যে অবস্থিত রোমগুলি বায়ুর ধুলিকণা আটকে কেবলমাত্র গ্যাসীয় বস্তু ও ঘ্রাণ অনুভূতিকে নাসাপথে পাঠায়। নাসাপথের ঘ্রাণকোশগুলি এই উদ্দীপনা গ্রহণ করে তা ঘ্রাণস্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়, যার ফলে আমরা ঘ্রাণের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারি। ঘ্রাণজাত সংবেদন অনেকসময় স্বাদ সংবেদনের সঙ্গে মিশে থাকে যেমন-খাদ্যের গন্ধ।
ঘ্রাণগত সংবেদনের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল যে, বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে এই সংবেদনে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে, এই সংবেদন আর পাওয়া যায় না। যেমন- মাছের বাজারে ঢুকলেই মাছের গন্ধ নাকে এসে ঢোকে। কিন্তু মাছ বিক্রেতার অতটা গন্ধ লাগে না। তা ছাড়া ঘ্রাণ গ্রহণের ক্ষমতা সব মানুষের সমান থাকে না, অল্পেতেই অনেকে গন্ধ পেয়ে থাকেন যা অন্যরা পায় না। আবার দেখা যায়, যদি কোনো মানুষ প্রথমে দুর্গন্ধময় বস্তুর ঘ্রাণ নিয়ে পরে সুগন্ধযুক্ত বস্তুর ঘ্রাণ নেয়, তাহলে শেষোক্ত গন্ধটি সে বেশ স্পষ্ট এবং তীব্রভাবে অনুভব করে।
ঘ্রাণগত সংবেদনের জ্ঞানগত মূল্য নেই, তবে অনুভূতিমূলক মূল্য আছে।
৫। স্বাদ সংবেদন সম্পর্কে টীকা লেখো।
স্বাদ সংবেদন
সংবেদন হল বস্তুর জ্ঞান আহরণের একটি ধাপ। মানবদেহে যে বস্তুটির সংবেদন হয়, তাকে বস্তুর গুণ বলে। এইরকমই একটি গুণ হল মানবদেহের স্বাদজ গুণ। স্বাদের মধ্য দিয়ে যদি আমরা কোনো বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে পারি, তাকে বলে স্বাদ সংবেদন। আমরা কেবল তরল পদার্থের স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। খাদ্যবস্তু জিহ্বার লালার সঙ্গে মিশে তরল অবস্থায় পরিণত হলে সেই তরল পদার্থ প্যাপিলার মধ্যস্থিত স্বাদকোরকে পৌঁছোয়। স্বাদকোরকের মধ্যে যে কোশ আছে তা থেকে স্নায়ুগুচ্ছ হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছোয়। ওই স্নায়ু দ্বারা বাহিত হয়ে উদ্দীপনা মস্তিষ্কে পৌঁছোলে স্বাদ সংবেদনের সৃষ্টি হয়।
মূল স্বাদ: চার রকমের মূল স্বাদ আছে। যথা-মিষ্টি, অম্ল, লবণাক্ত, তিক্ত। জিহ্বার সব অংশই সব স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না। কতকগুলি প্যাপিলা বা পিড়কা মিষ্ট স্বাদ দান করে আবার কতকগুলি অম্ল স্বাদ, কতকগুলি লবণাক্ত জিনিসের স্বাদ দান করে। আবার কতকগুলি প্যাপিলা – আছে যেগুলি চারটি স্বাদেরই সংবেদন দান করতে পারে। জিহ্বার অগ্রভাগে – মিষ্ট স্বাদ, জিহ্বার দুই পাশে লবণাক্ত এবং পিছনে দুই পাশে অম্ল এবং জিহ্বার ভিতরের দিকে তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করার ক্ষমতা সর্বাধিক।
অবস্থান: স্বাদকোরকের অবস্থান ভিন্ন।
নোনতা: জিহ্বার নিম্নতলের মধ্যভাগের দু-পাশে।
তেতো: জিহ্বার উপরিতলে পশ্চাদ্ভাগে।
মিষ্টি: জিহ্বার উপরিতলে সম্মুখভাগে।
টক: জিহ্বার উপরিতলে মধ্যভাগের দু-পাশে।
৬। স্বাদকোরক কাকে বলে? স্বাদ সংবেদনের উপর ঘ্রাণের প্রভাব লেখো।
স্বাদকোরক (Taste Buds): জিহ্বার উপরিভাগে ছোটো ছোটো গুটির মতো অংশ থাকে, যাকে বলে পিড়কা। পিড়কার পার্শ্বপ্রাচীরে স্বাদের সংজ্ঞাবাহী বিশেষ গ্রাহক কোশ থাকে। এগুলিকে স্বাদকোরক বলে। এই স্বাদকোরকগুলির মধ্যে আবার বেশ কতকগুলি স্বাদকোশ থাকে, যেগুলির মাধ্যমে স্বাদগ্রহণ করা হয়।
স্বাদ সংবেদনের উপর ঘ্রাণের প্রভাব: আমরা সাধারণত যাকে খাদ্যের বা পানিয়ের স্বাদ বলে মনে করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি স্বাদ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়। যাতে নাকে কোনো ঘ্রাণ না পৌঁছোয়, তার জন্য নাক বন্ধ করে কফি এবং স্বল্পমাত্রায় কুইনিন দ্রবণ পান করলে কিংবা আপেল ও পেঁয়াজের রস পান করলে এদের স্বাদের কোনো পার্থক্যই ধরতে পারা যায় না। কফি ও কুইনিন উভয়েই তিক্ত স্বাদের আবার আপেল ও পেঁয়াজের রস উভয়ই মিষ্টি। আমরা যে এদের স্বাদের পার্থক্য করি তা মূলত ঘ্রাণের ব্যাপারে। স্বাদ সংবেদন অধিকাংশক্ষেত্রে ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে থাকে। এজন্য সর্দি হলে ঘ্রাণ নেওয়া হয় না বলে আহার্য বস্তুর স্বাদও বোঝা যায় না।
৭। ত্বক সংবেদন সম্পর্কে টীকা লেখো।
ত্বক সংবেদন: ত্বক হল স্পর্শেন্দ্রিয় বা বলা যায় স্পর্শগত সংবেদনের ইন্দ্রিয় হল ‘ত্বক’। এটি সংবেদনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম। প্রতিটি প্রাণীর চাপ, শীতলতা, উন্নতা ইত্যাদি-এই জাতীয় সংবেদন থেকেই বোঝা যায়। এর গ্রাহক উক্ত অনুভূতি গ্রহণ করে উদ্দীপিত হয় এবং বিশেষ স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্পর্শকেন্দ্রে নিয়ে আসে, তখন অনুভূতিটি অনুভূত হয়।
ত্বক এপিডারমিস বা উপত্বক এবং ডারমিস (Epidermis and Dermis) এই দুটি স্তর নিয়ে গঠিত। ডারমিস স্তরে ঘর্ম গ্রন্থি, সিবেসিয়াস গ্রন্থি, কেশমূল থাকে। এ ছাড়াও আরও একটি স্তর যেটি চর্বির দ্বারা গঠিত থাকে, এগুলিকে একত্রে স্পর্শজাত গ্রাহক বলে। স্পর্শজাত সংবেদন আবার চার প্রকার, যথা- শৈত্য সংবেদন, উন্নতা সংবেদন, বেদনা সংবেদন, চাপ সংবেদন।
ত্বকে বিস্তৃত স্নায়ুতন্ত্রের প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনাবহী গ্রাহক কোশগুলি স্পর্শজনিত উদ্দীপনায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এই উদ্দীপনা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছোয় এবং আমরা স্পর্শ অনুভব করি।
সুতরাং ত্বক সংবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার দ্বারা আমরা চাপ, উন্নতা, শৈত্য, ব্যথা প্রভৃতি অনুভব করতে পারি। ত্বক সংবেদন ছাড়া এগুলি আমরা অনুভব করতে পারি না।
৮। বিশেষ সংবেদন বা ইন্দ্রিয় সংবেদন কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
বিশেষ বা ইন্দ্রিয় সংবেদন
বাহ্য ইন্দ্রিয় বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সংবেদন সৃষ্টি হয়, তাকে ইন্দ্রিয় বা বিশেষ সংবেদন বলে।
আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। যথা-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। এর মধ্যে যে-কোনো একটি উদ্দীপিত হলে এবং সেই উদ্দীপনা মস্তিষ্কে পৌঁছোলে যে সংবেদনের সৃষ্টি হয়, তাকেই ইন্দ্রিয় বা বিশেষ সংবেদন বলে।
বিশেষ সংবেদনের বৈশিষ্ট্য
[1] বাহ্য উদ্দীপকনির্ভর: দেহের উপরিভাগে অবস্থিত বিভিন্ন ইন্দ্রিয়, যথা-চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক বিভিন্ন ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করে, এরূপ সংবেদন বাহ্য উদ্দীপকের সংস্পর্শে উৎপন্ন হয়। যেমন-আলো চোখকে, শব্দ কানকে উদ্দীপিত করে।
[2] বাহ্য বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ: ইন্দ্রিয় সংবেদনের মাধ্যমে বহির্জগতের বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে। যেমন-কোনো জিনিসের রং, আকার, আয়তন ইত্যাদি।
[3] ইন্দ্রিয়নির্ভর, অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট সংবেদন: এই ধরনের সংবেদন ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে। এই সংবেদন স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে দেয় যে উদ্দীপক কোনো জায়গা থেকে আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর ক্রিয়া করছে।
[4] ইন্দ্রিয়ের বিভিন্নভা: ইন্দ্রিয়ের বিভিন্নতার জন্য সংবেদনও বিভিন্ন হয়। যেমন-দর্শনজাত সংবেদন (Visual Sensation), শ্রবণজাত সংবেদন (Auditory Sensation), ত্বকজাত সংবেদন (Tactual Sensation), গন্ধজাত সংবেদন (Olfactory Sensation), স্বাদলব্ধ সংবেদন (Gustatory Sensation) ইত্যাদি।
[5] গুণগত পার্থক্য: বিশেষ সংবেদনের ক্ষেত্রে গুণগত পার্থক্য দেখা যায়। যেমন- দর্শন সংবেদনের সঙ্গে শ্রবণ সংবেদনের গুণগত পার্থক্য আছে। দর্শন সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বাহ্য জগতের সমস্ত জিনিস দেখতে পাই অন্যদিকে শ্রবণ সংবেদনের সাহায্যে বাইরের জগতের বিভিন্ন শব্দ শুনতে পারি।
[6] পরিমাণগত পার্থক্য: এই ধরনের সংবেদনে পরিমাণগত পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। যেমন-উজ্জ্বল তীব্র বৈদ্যুতিক আলোকের সংবেদন ও মৃদু বা ম্লান আলোকের সংবেদন একই জাতীয় সংবেদন হলেও পরিমাণের দিক থেকে দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
৯। দৈহিক সংবেদন বলতে কী বোঝো? দৈহিক সংবেদনের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
দৈহিক সংবেদন: দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরে পরিবর্তন ঘটার ফলে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, সেই উদ্দীপনা অন্তর্মুখী স্নায়ুপথে পরিচালিত হয়ে গুরুমস্তিষ্কে পৌঁছালে, যে ধরনের সংবেদনের উদ্ভব ঘটে, তাকে দৈহিক সংবেদন বা যান্ত্রিক সংবেদন বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য: দৈহিক সংবেদনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- আমাদের দেহের অভ্যন্তরে যন্ত্রের ক্রিয়ার ফলে এই সংবেদন সৃষ্টি হয়।
- শরীরের মধ্যে বিশেষ করে হৃদ্যন্ত্র, পাকস্থলী প্রভৃতির ক্রিয়ার ফলে এই ধরনের সংবেদন হয়।
- যখন আমাদের খিদে পায়, তখন পাকস্থলী সংকুচিত হয়। আর এই পাকস্থলীর পেশি সংকোচন হল দৈহিক সংবেদন।
- হৃদ্যন্ত্র, পাকস্থলী ছাড়াও যকৃৎ, ফুসফুস প্রভৃতির ক্রিয়ার ফলেও দৈহিক সংবেদন হয়।
- দৈহিক সংবেদনকে জটিল প্রক্রিয়া বলা হয়। কারণ এই সংবেদনের সঙ্গে পেশি, স্নায়ু ইত্যাদির সংবেদন যুক্ত থাকে।
- দৈহিক সংবেদন ইন্দ্রিয় সংবেদনের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন-খিদে পেলে তার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধ ও স্বাদেরও একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়।
- দৈহিক সংবেদন ঠিক কোথা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে অর্থাৎ এর উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা বেশ জটিল।
- এই সংবেদন আমাদের সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা ইত্যাদির ইঙ্গিত দেয়।
- দৈহিক সংবেদন অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। তাই এর একটিকে অপরটির থেকে পৃথক করা যায় না।
১০। পেশি সংবেদন কাকে বলে? মানবদেহে তিন ধরনের পেশি। সংবেদনের সংজ্ঞা দাও।
পেশি সংবেদন (Motor or Muscular Sensation)
আমাদের দেহের মধ্যেকার পেশিগুলো নাড়াচাড়া করার ফলে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনার জন্য একরকম সংবেদন হয়। একে বলে পেশির সংবেদন। টিচেনার ও অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষামনোবিদ পেশিগত সংবেদনকে চেষ্টীয় সংবেদন (Motor or Kinaesthetic)-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পেশি সম্পর্কীয় বিভিন্ন বিষয়গুলি হল- পেশি (ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক), অস্থিসন্ধি, টেনডন।
পেশিগত সংবেদনের শ্রেণিবিভাগ
পেশি সংবেদনকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি দিকের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা- সংবেদন, চেষ্টীয় সংবেদন, পার্শ্বীয় সংবেদন।
- শস্তি প্রয়োগঘটিত সংবেদন: কোনো কাজ করার সময় বাহ্যিক বস্তুর উপর শক্তি প্রয়োগের ফলে যে বিশেষ ধরনের সংবেদন সৃষ্টি হয়, তাকে শক্তি প্রয়োগঘটিত সংবেদন বলে।
- চেষ্টীয় সংবেদন: মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা পেশি চালনা করার জন্য যে বিশেষ প্রকার সংবেদন সৃষ্টি হয়, তাকে চেষ্টীয় সংবেদন বলে। যেমন- হাত বা পা নাড়ানোর জন্য যে সংবেদন সৃষ্টি হয়, তাই চেষ্টীয় সংবেদন।
- পার্শ্বীয় সংবেদন: বহির্জগতের কোনো পরিবর্তন আনার জন্য মানুষ যখন কাজ করে তখন তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয় এবং তার ফলে যে বিশেষ প্রকার সংবেদন সৃষ্টি হয়, এই বিষয়টিকেই পার্শ্বীয় সংবেদন বলে।
সুতরাং, এই জাতীয় সংবেদনগুলি আমাদের কর্মেন্দ্রিয়ের (Effector Organ) ক্রিয়ার ফলেই ঘটে থাকে।.
১১। ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ কী? সংবেদনকে ভৌত ঘটনা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ার ফল বলা হয় কেন?
ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ
ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের অর্থ হল ইন্দ্রিয়ের তীক্ষ্ণতা ও কার্যকারিতা বাড়ানো। ইন্দ্রিয় হল জ্ঞানের প্রবেশপথ এবং সংবেদন হল প্রাথমিক অভিজ্ঞতা যা প্রাণীরা ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিবেশ থেকে অর্জন করে। তাই অনুশীলনের মাধ্যমে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় রেখে বিষয়বস্তুকে জানাই হল ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ (Sense Training)।
সংবেদন ভৌত ঘটনা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ার ফল
সংবেদন হল বস্তুকেন্দ্রিক মানসিক অবস্থা, এটি সর্বদাই কোনো অস্তিত্বযুক্ত বস্তুর গুণকে নির্দেশ করে। কোনো বস্তুকে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে উদ্দীপক বলা যায় যদি সেই বস্তু সেই বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইন্দ্রিয়কে উত্তেজিত করে মস্তিষ্কে প্রাথমিক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। আর সংবেদন হল এই উদ্দীপক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। অর্থাৎ কোনো ভৌত ঘটনা এবং মানসিক অবস্থার পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলেই সংবেদন ঘটে থাকে। যেমন-শব্দ, আলো ইত্যাদি আমাদের ইন্দ্রিয়ে এসে পৌঁছোলে আমাদের উদ্দীপকের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। অর্থাৎ আমরা শুনতে পাই বা দেখতে পাই। এখানে শব্দতরঙ্গ বা আলোকরশ্মি তরঙ্গ বা সাধারণ অর্থে কোনো উদ্দীপকই হল ভৌত ঘটনা। কিন্তু দেখা, শোনা ইত্যাদি হল মানসিক প্রক্রিয়া।
আবার দেখা যায়, লঙ্কা মুখে দিলে আমরা ঝাল অনুভব করি। এখানে লঙ্কা হল উদ্দীপক, একটি ভৌত ঘটনা, আর ঝাল স্বাদ হল মানসিক প্রক্রিয়া। তাই ভৌত ঘটনা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে • সংবেদন সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ভৌত ঘটনা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ার ফলই হল সংবেদন।
বর্তমানে এইসব ভৌত ঘটনার সঙ্গে সংবেদনের যথার্থ সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য বিজ্ঞানের একটি শাখার উদ্ভব হয়েছে, যার নাম হল Psycho-Physics। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন জি টি ফেচনার (GT Fechner)। এই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল মানসিক অভিজ্ঞতা ও বস্তুর মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমান আছে, তা নির্ণয় করা।
Read More : Jimmy Valentine Question Answer