সন্ত্রাসবাদ ও বিশ্বের সংকট রচনা

সন্ত্রাসবাদ ও বিশ্বের সংকট রচনা
সন্ত্রাসবাদ ও বিশ্বের সংকট রচনা

ভূমিকা

অভিশপ্ত ‘নাইন ইলেভেন’ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষে সম্প্রতি ‘উরি’-র ঘটনা প্রমাণ করে নয়া সন্ত্রাসবাদ এখন বিশ্ববাসীর কাছে সংকট রূপে উপস্থিত হয়েছে। উগ্রপন্থার নতুন দোসর এই সন্ত্রাসবাদ ক্ষমতায়ন, রাজনীতি, ধর্ম, মৌলবাদ প্রভৃতিকে আশ্রয় করে নতুন নতুন ভাবে উপস্থিত হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। এই নয়া সন্ত্রাসবাদের বৈশিষ্ট্য হল নিজস্ব লক্ষ্য পূরণের জন্য চোরাপথে যে কোন উপায়ে অর্থাৎ গুপ্তহত্যা প্রভৃতির মাধ্যমে জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি করা-যার পশ্চাতে রয়েছে স্বার্থ, লোভ ও প্রতিহিংসা। এজন্য চাই সার্বিক সচেতনতা, প্রতিরোধ ও পারস্পরিক আলাপ আলোচনা।

উৎস

সন্ত্রাসবাদ একদিনে গড়ে ওঠেনি, বঞ্চনা-হতাশা, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা বাড়তে বাড়তে তা উগ্ররূপ ধারণ করে সন্ত্রাসবাদের চেহারা নেয়। বর্তমান এই যান্ত্রিক পৃথিবীতে সহনশীলতার অভাবে, বস্তুবিশ্বের প্রতি আকর্ষণে, অতিরিক্ত ভোগাকাঙ্ক্ষার কারণে সন্ত্রাসবাদ সমগ্র বিশ্বে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আসলে সন্ত্রাসবাদের বীজ মানুষেরই মনে বাসা বেঁধেছে, বৈরী প্রতিবেশী তাকে মহীরুহ করতে সাহায্য করে, শত্রুর শত্রু হয়ে যায় মিত্র। এমনকি ধনী দেশগুলির মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের ক্ষেত্র হওয়া, অর্থনীতির ভিত দেশের মধ্যে মজবুত না হওয়া, ধর্মীয় স্বার্থান্ধতা, বেকারত্ব, মৌলবাদ, মতাদর্শের ভিন্নতা, ঐতিহ্যচ্যুতি ও দিশাহীনতা এবং প্রতিবেশিরা শত্রু এই মনোভাব সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর।

আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিস্ফোরণের পর বিশ্বে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের চেহারা যেমন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তেমনি কোনো কোনো রাষ্ট্রের মদত ও সহযোগিতাও বিশ্ববাসীর কাছে উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি ভারতে উরি-র ঘটনা, জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্তের ঘটনা, জুলাইতে ঢাকার গুলশনের ঘটনা, ১৪ই জুলাই (২০১৬) ফ্রান্সে নিস শহরে বাস্তিল দিবস পালনের সময় উৎসবে মাতোয়ারা জনগণের উপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে ৮৪ জনের মৃত্যু ও ২০২ জনের আহত হওয়ার ঘটনা, তার আগে ফ্রান্সে ২০১৫-র জানুয়ারি ও নভেম্বরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলা, ২০১৬-র মার্চ মাসে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস-এর এয়ারপোর্টে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে ৩৫ জনের মৃত্যু, ২০১৬-র অক্টোবরে সোমালিয়াতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ, ইরাকের বাগদাদে ও কেনিয়া এবং বালুচিস্তানে সন্ত্রাস, ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে বাগদাদ, আফগানিস্তান, তানজানিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, লিবিয়াতে সন্ত্রাস, ২০১৬-র আগস্টে কুর্দিশদের সঙ্গে তুর্কিদের সংঘর্ষ সন্ত্রাসবাদের নবতম রূপকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে। এরও পূর্বে এশিয়ার লেবানন, সিরিয়া, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, ইথিওপিয়া, কসোভা আলবেনিয়া, চেচনিয়া, জিংজিয়াং-এর ঘটনা প্রমাণ করে সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ কত বিস্তৃত ও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

ভারতের সন্ত্রাস

ভারতের সন্ত্রাসবাদ বহু পুরানো উপসর্গ। ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় ধর্ম ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদের বলি হতে হয়েছে দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীকে। তা ছাড়া সীমান্ত পারের সন্ত্রাস তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর তো অনেকদিন ধরে হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদীদের পাঠশালা এবং ভারতে জঙ্গী পাচারের বিশ্বস্ত ক্ষেত্র। জম্মু কাশ্মীরে নিত্য গোলাগুলি, সংসদে হামলা, মুম্বাই বিস্ফোরণ, গুজরাটে অক্ষরধাম মন্দিরে সন্ত্রাস এবং অতি সম্প্রতি পাঠানকোট ও উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলা সন্ত্রাসবাদের রূপকেই স্পষ্ট করে।

উদ্দেশ্য ও সংকট

সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ভীতি সঞ্চার করে দেশের সুস্থিতিকে বিনষ্ট করে দেওয়া। নিজেদের মৌলবাদী কিম্বা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরি করে মানবসভ্যতার মহতী দিককে বিনষ্ট করে উল্লসিত হওয়া যা মানসিক বিকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদীদের ভুল বুঝিয়ে ধর্মের জিগির তুলে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার চেষ্টা করা হয়। আসলে সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্য হল বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তৃপ্তিসুখ অনুভব করা। আর এই সন্ত্রাস এখন মাধ্যম হয়ে উঠেছে প্রতিবেশিকে কিংবা প্রতিপক্ষকে জব্দ করার একমাত্র অস্ত্র।

প্রতিকার

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, সহনশীলতা ও সহযোগিতার উপর ভরসা রেখে পরস্পরের সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দিলে, এই নেতিবাচকতা অনেকটা কেটে যেতে পারে। তাছাড়া পৃথিবী যেখানে দ্রুত পরিবর্তনশীল সেখানে ধর্ম ও মৌলবাদ যে আফিম মাত্র তা যে মনুষ্যত্বের পরিপন্থী তা সন্ত্রাসবাদীদের উপলব্ধি করতে । হবে। সন্ত্রাসবাদ যে সমস্যা সমাধানের চিরন্তন বা দীর্ঘস্থায়ী পথ নয় একথা সন্ত্রাসবাদীদের উপলব্ধি করতে হবে। রাষ্ট্রেরও উপলব্ধি করতে হবে সন্ত্রাসবাদীরাও মানুষ, তাদেরকেও মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে।

উপসংহার

সন্ত্রাসবাদীদের একথা মানতেই হবে মানুষের কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, প্রতিপক্ষও নেই। মানবত্বের অপমান ঘটিয়ে যারা পৈশাচিক উল্লাসে মাতে, তারা যে মানবতার শত্রু একথা বুঝিয়ে দিতে হবে সন্ত্রাসবাদীদের। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরি করা গেলেও কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো হয়-ই না, বরং মহৎ প্রাণের বিনষ্টি ঘটে। এজন্য সর্বস্তরে চাই সার্বিক সচেতনতা ও সদিচ্ছা। তাহলে বিশ্বের এই সংকট অনেকটা উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।

Leave a Comment