দ্রব্য সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মত

গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর শিষ্য হলেন অ্যারিস্টট্ল। অ্যারিস্টটলের ‘দ্রব্য’ সম্পর্কিত মতটি প্রকৃতপক্ষে প্লেটোর মতের সংশোধিত রূপ। তিনি মূলত তাঁর দুটি গ্রন্থ ‘Metaphysics’ ও ‘Categories’ -এ দ্রব্য সম্পর্কিত আলোচনা করেছেন।
প্লেটোর ধারণা সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মত
প্লেটোর ধারণাবাদ খণ্ডন করে বলেন যে, সামান্য ধারণা দ্রব্য নয়। তাঁর মতে বিশেষের জগৎ অতিরিক্ত সামান্যের জগৎ বলে কিছু নেই। জগৎ একটাই- বিশেষ ও সামান্যের সম্মিলিত জগৎ। কারণ বিশেষ কোনো মানুষকে আশ্রয় না করে যেমন মানুষ জাতি থাকতে পারে না তেমনই মানুষ জাতিকে আশ্রয় না করে বিশেষ মানুষও থাকতে পারে না। অ্যারিস্টটলের মতে, সামান্য হল সাধারণ ধর্ম যা বিশেষ বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিতে আশ্রিত থাকে।
সামান্য ধর্মটি একই জাতিভুক্ত বিভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে একইরূপে থাকে, ব্যক্তি বা বস্তুভেদে সামান্য ধর্মটির কোনো ভিন্নতা হয় না। যেমন- নীলত্ব সামান্যটি সব নীল বস্তুতে একইভাবে থাকে। এখন ধর্ম কখনও স্বনির্ভর হতে পারে না। সর্বদা একটি আধারকে আশ্রয় করে থাকে। সুতরাং ধারণা বা আকার দ্রব্য নয়। দ্রব্য হল ধারণা বা সামান্য ও বিশেষের সমন্বয়।
অ্যারিস্টটলের মতে দ্রব্য শব্দটির বিভিন্ন অর্থ
অ্যারিস্টট্ল ‘দ্রব্য’ শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন।
দ্রব্যের মুখ্য ও গৌণ অর্থ
‘দ্রব্য’ শব্দটিকে অ্যারিস্টট্ল দুটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন মুখ্য অর্থ ও গৌণ অর্থ।
মুখ্য অর্থ
মুখ্য অর্থে ‘দ্রব্য’ বলতে অ্যারিস্টট্ল বিশিষ্ট মূর্ত বস্তুকে বুঝিয়েছেন। এই অর্থে দ্রব্য হল সামান্য ও বিশেষের সমন্বয়। বিশেষে আশ্রিত না হলে সামান্যকে যেমন দ্রব্য বলা যায় না তেমনই সামান্য ধর্ম আশ্রিত না হলে বিশেষকেও দ্রব্য বলা যায় না। তাঁর মতে মুখ্য দ্রব্য হল ‘এই মানুষটি’, ‘ওই টেবিলটি’, ‘ওই গাছটি’ জাতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু। এগুলি মুখ্য অর্থে দ্রব্য। তার কারণ এই দ্রব্যগুলি সবসময় কোনো গুণ ও ক্রিয়ার আশ্রয়রূপে ব্যবহৃত হয়।
অ্যারিস্টটলের মতে মুখ্য দ্রব্যগুলি বিধেয়ের আশ্রয় (আধার) বা উদ্দেশ্যরূপে ব্যবহৃত হয় এবং এগুলিকে বিধেয় বা বিশেষণ বা আশ্রিত হিসেবে প্রয়োগ করা যায় না। স্পষ্টতই, বিশিষ্ট মূর্ত বস্তুরূপে দ্রব্য অর্থাৎ মুখ্য দ্রব্য উপাদান (আধার) এবং আকার (সারধর্ম)-এর সমন্বয়ে গঠিত। অ্যারিস্টটলের মতে, এই আধার হল জড় উপাদান এবং আকার হল অজড়। এই আলোচনার ভিত্তিতে, মুখ্য দ্রব্যের সংজ্ঞা প্রদান করে বলা যায়- যে স্বনির্ভর পদার্থ বাক্যের উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, তাই হল মুখ্য দ্রব্য। যেমন-
(ক) প্লেটো একজন দার্শনিক (প্লেটো = নামপদ = উদ্দেশ্য = দ্রব্য)।
(খ) রবীন্দ্রনাথ হন মানুষ (রবীন্দ্রনাথ = নামপদ = উদ্দেশ্য = দ্রব্য)।
গৌণ অর্থ
অ্যারিস্টটল গৌণ অর্থে ‘দ্রব্য’ বলতে ব্যক্তির পরিবর্তে জাতি (Genus) ও প্রজাতি বা উপজাতিকে (Species) বুঝিয়েছেন। এই অর্থে দ্রব্য হল সেই সকল বস্তু বা বস্তুশ্রেণি যা মুখ্য দ্রব্যের উপর অর্থাৎ বিশিষ্ট মূর্ত বস্তু বা নির্দিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তি দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে গৌণ দ্রব্যগুলি মুখ্য দ্রব্যের বিধেয় বা বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এগুলি নিজ সারধর্মের বা প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির উদ্দেশ্যরূপেও ব্যবহৃত হতে পারে। কাজেই এককথায় বলা যায়, যে অন্য নির্ভর পদার্থ বাক্যের উদ্দেশ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তা-ই হল গৌণ দ্রব্য। যেমন-
(ক) মানুষ হয় প্রাণী (মানুষ = প্রজাতি = উদ্দেশ্য = দ্রব্য)।
(খ) রবীন্দ্রনাথ হন মানুষ (মানুষ = প্রজাতি = বিধেয় = দ্রব্য)।
আপাতদৃষ্টিতে দ্রব্য সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের উপরোক্ত দুটি অর্থ পরস্পর বিরোধী মনে হয়, কিন্তু আসলে এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কেন-না অ্যারিস্টটল যখন মুখ্য অর্থে বিশিষ্ট দ্রব্যের কথা বলেন তখন তাঁর অভিমত হল দ্রব্য বিশেষ ও সামান্যের সমন্বয়ে বিশিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তি। আর অ্যারিস্টট্ল যখন গৌণার্থে সামান্যকে দ্রব্য বলেন, তখন তাঁর অভিমত হল সামান্য ব্যতীত ব্যক্তি বা বস্তুর কোনো পরিচিতি থাকে না। অর্থাৎ ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয় তার সামান্য ধর্মের উপর নির্ভরশীল। কাজেই এই অর্থে দ্রব্য হল জাতি বা প্রজাতি।
দ্রব্য হল স্বনির্ভর স্ব-সত্তাবান
অ্যারিস্টট্ল মনে করেন, অধিবিদ্যার প্রধান আলোচ্য বিষয় হল সত্তা বা অস্তিত্বের স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত আলোচনা। বিভিন্ন প্রকার সত্তা, যেমন- দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া, অবস্থা ইত্যাদির মধ্যে কেবল দ্রব্যেরই প্রকৃত সত্তা আছে। আর দ্রব্যের সত্তা আছে বলেই গুণ, ক্রিয়া, অবস্থা প্রভৃতি পদার্থগুলির সত্তা বা অস্তিত্ব সম্ভব হয়। এইজন্যই অ্যারিস্টট্ট্ল দ্রব্যের সত্তাকে মূল সত্তা বা প্রধান সত্তা বলেছেন। আর এই সত্তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না, এটি স্বনির্ভর ও স্ব-সত্তাবান। স্পষ্টতই অ্যারিস্টটলের মতে, দ্রব্য হল তাই যা মুখ্যত এবং নির্বিশেষভাবে সত্তাবান।
দ্রব্য হল বিশিষ্ট মূর্তবস্তু
এই জগতে বিচিত্র প্রকারের নানা বস্তু আছে। দ্রব্য হল সেইসকল বস্তুর পরিচয়জ্ঞাপক বা স্বাতন্ত্র্যজ্ঞাপক পদার্থ। দ্রব্য হল বিশিষ্ট পদার্থ। কারণ দ্রব্য কোনো বস্তুর পরিচয় জ্ঞাপন করে। দ্রব্যই আমাদের সাহায্য করে বস্তুটিকে একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট বস্তু হিসেবে চিনতে। যেমন- ‘পর্বত’ দ্রব্য নয়। কারণ পর্বত কোনো বিশিষ্ট বস্তু নয়। কিন্তু ‘হিমালয়’ দ্রব্য। কারণ হিমালয় পর্বত হিসেবে একটি বিশেষ পর্বতকে নির্দেশ করে।
দ্রব্য হল বাক্যের উদ্দেশ্য
দ্রব্যবাচক শব্দটি অবশ্যই কোনো বাক্যের উদ্দেশ্য হবে, কখনও বিধেয় হবে না। অর্থাৎ দ্রব্য হল নামপদ। দ্রব্য হল তাই যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়। যেমন- ‘সোনা হয় ভারী’ -এই বাক্যে ‘সোনা’ হল উদ্দেশ্য বা দ্রব্য, যার উপর ‘ভারিত্ব’ ধর্মটি আরোপ করা হয়েছে।
দ্রব্য হল অপরিবর্তনীয় বা সথায়ী সত্তা
দ্রব্য হল সমস্ত গুণ ও ক্রিয়ার আধার বা আশ্রয়স্থল। এখন যদি দ্রব্যকে গুণ ও ক্রিয়ার আধার বলা হয়, তাহলে বলতে হবে যে, দ্রব্য হল ‘স্থায়ী সত্তা’। কেন-না গুণ ও ক্রিয়া অস্থায়ী এবং পরিবর্তনশীল। দ্রব্য-সত্তা ছাড়া পরিবর্তনের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। দ্রব্য হল সারবস্তু, যার পরিবর্তন হয় না। দ্রব্য হল পরিবর্তনের অন্তরালে এক অপরিবর্তনীয় স্থায়ী সত্তা।
দ্রব্যের শ্রেণিবিভাগ
‘Metaphysics’ গ্রন্থে অ্যারিস্টট্ল তিন প্রকার দ্রব্যের উল্লেখ করেছেন। যথা- (১) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অনিত্য দ্রব্য (যেমন- উদ্ভিদ, প্রাণী ইত্যাদি), (২) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও নিত্যদ্রব্য (যেমন- সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা ইত্যাদি) ও (৩) অতীন্দ্রিয় ও নিত্যদ্রব্য (যেমন- ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি)।
সমালোচনা
অ্যারিস্টটলের ‘দ্রব্যতত্ত্ব’ আলোচনা করে দেখা যায়, তাঁর দ্রব্যতত্ত্বে বেশ কিছু স্ববিরোধিতা ও অসংগতি বিদ্যমান। যথা-
প্রথমত অ্যারিস্টটল নিরপেক্ষ অস্তিত্বকে যখন দ্রব্যের লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন, তখন জাতি ও প্রজাতিকে দ্রব্য বলা সংগত নয়। কারণ জাতি ও প্রজাতির অস্তিত্ব নিরপেক্ষ নয়।
দ্বিতীয়ত প্লেটোর সামান্য ধারণাকে খণ্ডন করে অ্যারিস্টট্ল দ্রব্যের আলোচনা শুরু করলেও গৌণ দ্রব্য হিসেবে জাতি বা প্রজাতিকে দ্রব্যের মর্যাদা দিয়ে তিনি প্রকারান্তরে প্লেটোকেই সমর্থন করেছেন।
তৃতীয়ত অ্যারিস্টট্ল যে তিন প্রকার দ্রব্যের উল্লেখ করেছেন, সেখানে দ্রব্যকে কখনও তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলেছেন, কখনও আবার অতীন্দ্রিয় বলেছেন, কখনও নিত্য বলেছেন, কখনও আবার অনিত্য বলেছেন।
চতুর্থত আলোচনার শুরুতে তিনি দ্রব্যকে সামান্য ও বিশেষের সমন্বিতরূপ হিসেবে স্বীকার করলেও, পরবর্তী সময়ে তিনি সামান্য-কে বিশেষ থেকে পৃথকীকৃত করেছেন।
উপরোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলি থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, ‘দ্রব্য’ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মতটি পরবর্তী পাশ্চাত্য দার্শনিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
আরও পড়ুন : আদরিণী গল্পের MCQ প্রশ্ন উত্তর
আরও পড়ুন : বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধের MCQ